সদ্যপ্রয়াত নারীনেত্রী আয়েশা খানমের স্মৃতিচারণ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের একজন দক্ষ ও যোগ্য নেত্রী ছিলেন আয়েশা খানম। যার সুদক্ষ নেতৃত্ব আজকের বাংলাদেশ মহিলা পরিষদকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা যারা নারী আন্দোলনের কর্মী আছি, সবাই তার নেতৃত্বের দক্ষতাকে ধারণ করে মহিলা পরিষদকে সামনের দিনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করব।’
শনিবার (২ জানুয়ারি) ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আয়েশা খানম।
ফওজিয়া মোসলেম আরও বলেন, ‘আমরা একই সময়ে পড়াশোনা করেছি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। ধারাবাহিকভাবে তিনি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হওয়ায় সমাজ সংস্কারে সাম্য প্রতিষ্ঠার চিন্তা করতেন। তার মতো একজন দক্ষ ও যোগ্য নেত্রীকে হারিয়ে আমরা অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি।’
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জানান, আজ সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আয়েশা খানমের মরদেহ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাখা ছিল। সেখানে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা মহানগর কমিটি, সংগঠনের নারায়ণগঞ্জ শাখা ও বেলাবো শাখা শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পাশাপাশি সংগঠনের কর্মকর্তাবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে দীপ্ত ফাউন্ডেশনের জাকিয়া কে হাসান, নারী প্রগতি সংঘের শাহনাজ সুমী, সেভ দ্য চিলড্রেনের উম্মে সালমা, নারীমুক্তি সংসদের সাবিকুন্নাহার, নারীপক্ষের শিরিন হক, দলিত নারী ফোরামের মনি রানী দাশ, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এবং হিন্দু, বৌদ্ধ -খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ঐক্য-ন্যাপ, মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নারী সেল’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রয়াত নেত্রীকে শ্রদ্ধা জানান। এরপর নেত্রকোনায় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক করবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ফওজিয়া মোসলেম আরও জানান, এ সময় নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আয়শা খানম মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুফিয়া কামালের যে আদর্শকে ধারণ করে সংগঠনকে পরিচালিত করেছেন তাকে সমুন্নত রেখে কাজ এগিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করেন সংগঠনের নেত্রীরা।
মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আয়েশা খানম মনে-প্রাণে একজন মানবাধিকার কর্মী ছিলেন। নারীর অধিকার আদায়ে তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। কীভাবে সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার একজন নারী মূলধারায় ফিরে আসতে পারে সেজন্য চেষ্টা করতেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নারীর অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন, তারপরও সবসময় মহিলা পরিষদের কর্মসূচিতে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
তিনি আরও বলেন, মহিলা পরিষদকে নতুন ধারায় নতুনভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি চেষ্টা করতেন। একুশ শতকের নারী আন্দোলনের জন্য কীভাবে সংগঠক, কর্মী তৈরি করা যায় সেজন্য অনেকসময় দিয়েছেন, পরিশ্রম করেছেন। মহিলা পরিষদ নতুন প্রজন্মের হাতে কীভাবে এগিয়ে যাবে সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আমরা সবাই তার সেই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেয়ার সবসময় বদ্ধপরিকর আছি এবং থাকব।
এদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আয়েশা খানম বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষে বঞ্চিত অধিকারহীন নারীদের অধিকার আদায়ে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন এক অকৃত্রিম অভিভাবককে হারাল।
পাকিস্তান শাসনামলে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ১৯৬২ সালের আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেন। ডামি রাইফেল হাতে ঢাকায় নারী শিক্ষার্থীদের মিছিলের যে ছবি আলোচিত হয়, তাতে আয়েশা খানমও ছিলেন।
নেত্রকোনার গাবড়াগাতি গ্রামে ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর জন্ম আয়েশা খানমের। তার বাবার নাম গোলাম আলী খান এবং মা জামাতুন্নেসা খানম। তিনি ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া রোকেয়া হলের সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি ছিলেন। মৃত্যুকালে আয়েশা খানমের ৭৪ বছর বয়স হয়েছিল । তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন।
এওয়াইএইচ/এসএস/এসজে/এমকেএইচ