পরিবারের সদস্য বেশি থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পড়ার সময় ১৯৯২ সালে আমার বিয়ে হয়। বাবার দুই পরিবারের কারণে আমার দুই মায়ের ১১ জন সন্তান ছিল। আমার যখন বিয়ে হয় তখন ঠিকমতো শাড়িও পরতে পারতাম না। স্বামী ছিলেন বেকার। তিস্তা পাড়ে তাদের অনেক জমি থাকলে ভাঙনে সেগুলো বিলীন হয়ে যায়। পরে খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ দোহলপাড়া গ্রামের বাখালীটারীতে মাত্র ১০ শতক জমি কিনে বসবাস শুরু করি। সংসারের এমন অবস্থা ছিল যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার দোহলপাড়া গ্রামের আমিনুর রহমানের স্ত্রী লিলিফা বেগম। তিনি স্কুল-কলেজ ও কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে নিজেই স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে কিশোরী নারী ক্লাব গঠন করে কিশোরীদের মাধ্যমে বর্তমানে এসব প্যাড বিক্রি করছেন।
কিশোরী নেত্রীদের ১১টি করে প্যাড নিজে গিয়ে দিয়ে আসতেন। সেখান থেকে ১০টি প্যাডের টাকা নিতেন আর যে বিক্রি করে দিত সে পেত একটি করে প্যাড। টুনিরহাট বাজারে ‘লিলিফার তিস্তা হাইজিন সেন্টার’ নামে একটি দোকান রয়েছে। বাড়িতে বসে এসব প্যাড তৈরি করতেন। লিলিফার আয়ের ওপর নির্ভর করে এখন বড় মেয়ে আইরিন বেগম নীলফামারী সরকারি মহিলা কলেজে মাস্টার্সে পড়েন, মেজ মেয়ে শিরিন আক্তার নীলফামারী সরকারি মহিলা কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষে ও ছোট মেয়ে আমিনা বেগম গোমনাতী কম্পিউটার কলেজে এইচএসসি পড়াশুনা করছে।
যে বয়সে খেলার সাথীদের সঙ্গে ছুটে বেড়ানোর কথা, যে বয়সে সংসার সম্পর্কে কিছু জানার কথা নয়, সে বয়সে বিয়ে হয় লিলিফা বেগমের। বাবার বাড়িতে সদস্য সংখ্যা বেশি থাকায় যে ভোগান্তি ছিল, শ্বশুর বাড়িতে এসেও দেখেন একই অবস্থা। পরিবারের সাত সদস্যের রান্না করতে হতো। লোকসংখ্যা বেশি থাকায় সংসারে অভাব লেগেই থাকত।
হঠাৎ করে একদিন পারিবারিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সন্তান দেরি করে নেয়ায় শাশুড়ি-ননদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে লিলিফাকে। তিনি কোনো কাজ করতে পারেন না বলে খোটা দেয়া হতো। পরিবারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। একপর্যায়ে লিলিফা বেগমকে সংসার থেকে আলাদা করে দেয়া হয়। বিয়ের চার বছর যেতে না যেতেই তার কোলজুড়ে আসে কন্যাসন্তান। এভাবে একে একে লিলিফা তিন কন্যাসন্তানের জননী হন।
স্বামীর আয়ের তেমন কোনো উৎস ছিল না। তার বাবার আবাদি ও অনাবাদিসহ মোট ৬০ শতাংশ জমিতে যা আবাদ হতো তা দিয়েই অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হতো। এভাবে লিলিফা আর পেরে উঠতে পারছিলেন না। পরে হাঁস-মুরগি পালন ও বসতবাড়িতে শাকসবজি চাষ করে সংসারে বাড়তি আয়ের পথ শুরু করেন। ২০১৪ সালে বাখালীটারী গ্রামে পল্লীশ্রী রিকল প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে অক্সফাম। লিলিফা ওই প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির ব্যবসা শুরু করেন।
বর্তমানে তার ব্যবসার মূলধন ৪৫ হাজার টাকা। লিলিফা বেগম জাগো নিউজকে জানান, বর্তমানে তার ব্যবসার পরিচিতি এবং লভাংশ দিন দিন বাড়ছে। তার একটি স্যানিটারি প্যাডের প্যাকেট তৈরিতে মোট খরচ হয় ৩০ টাকা। বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। একটি প্যাডে তার লাভ ১০ টাকা। স্যানিটারি প্যাড তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য হাইজিন সামগ্রী বিক্রি করে দৈনিক আয় করেন ৫৫০-৬০০ টাকা। এখন প্রতি মাসে গড়ে ৬ হাজার টাকা আয় হয় লিলিফা বেগমের।
আয়ের টাকা দিয়ে নিজের নামে ১৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দুটি গরু কিনেছেন, যার বর্তমান মূল্য ৭০ হাজার টাকা। লিলিফা জানান, তার পরিবারে এখন আর আগের মতো অভাব-অনটন নেই। তিনি এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।
বর্তমানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠাটি আরও বাড়ানোর চিন্তা করছেন লিলিফা বেগম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও স্কুলে-কলেজ বেশি করে তার তৈরি ন্যাপকিন প্যাড সরবরাহের পরিকল্পনা করছেন।
খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম লিথন বলেন, লিলিফা বেগমের তৈরি স্যানিটারি ন্যাপকিন এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাজারের চেয়ে কম দামে বিক্রি করায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়শ্রী রানী বলেন, লিলিফা বেগমের স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির বিষয়টি অনেক ইতিবাচক। কারণ তিস্তার পাড়ের একজন নারী স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তার এ উদ্যোগ এলাকার অনেক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগের পাশাপাশি আত্মনির্ভশীলতা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
জাহেদুল ইসলাম/এসআর/জেআইএম