মোহাম্মদ আবু হোসেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গোপালগঞ্জ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাবেশে যোগ দিয়ে তার ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছিলেন। পরে বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আবু হোসেন।
বিভিন্ন সময়ে অনেক কাছ থেকে দেখেছেন প্রিয় নেতা ‘মুজিব ভাই’কে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেসময়কার স্মৃতিচারণ করেন এ মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিক।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ শহরে অতি সাধারণভাবে ঘুরে বেড়াতেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি নিরাপত্তার বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখেননি নিজেকে। অতি সাধারণ মানুষও তার কাছে চলে যেতেন, বলতেন নিজের যতো সমস্যা। মন দিয়ে শুনতেন তাদের প্রিয় মুজিব ভাই। নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি দেখলে বঙ্গবন্ধু বলতেন, “আমি ওদের মুজিব ভাই। ওরা আমার কাছে আসবে। ওদের আটকে রেখো না। আমাকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফেরত দিয়েছে, পাকিস্তানিরা আমাকে মারেনি। আমার বাঙালিরা আমাকে মারবে না।” সেই মুজিব ভাইকে আমরা মেরে ফেললাম, এটা আমাকে অপরাধী করে দেয়।’
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি অনেক প্রখর ছিল উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা আবু হোসেন বলেন, ‘মুজিব ভাইয়ের স্মরণশক্তি অনেক প্রখর ছিল। কোথাও মিটিং করতে গেলে একবার দেখা হওয়া লোকটিকেও নাম ধরে ডাকতেন। তার পরিবারের খোঁজ-খবর নিতেন। সবাই তাকে দেখে মুগ্ধ হতেন। কী যেন একটা জাদু ছিল, সবাই তার প্রেমে পড়ে যেতেন। আমি বারবারই ছুটে যেতাম তার কাছে। একনজর দেখার জন্য। একটু কথা শোনার জন্য।’
একাত্তরের উত্তাল দিনে আবু হোসেন থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ রাতে সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি। পরের দিন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ময়দানে ভাষণ দেবেন। যথাসময়ে ময়দানে যাই। লাখো মানুষের জমায়েতে বঙ্গবন্ধু যা বললেন তা যেন সব বাঙালির কথা। তিনি যখন বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তখন বুঝতে বাকি রইলো না, কী হতে যাচ্ছে। পরেরদিনই গোপালগঞ্জ চলে আসি। গোপালগঞ্জ এসে যুদ্ধের জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিতে থাকি। পরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’
বঙ্গবন্ধু সবসময় দেশকে ভালোবেসেছেন, দেশের কথা ভেবেছেন। এমনই একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আবু হোসেন বলেন, ‘আমি একবার তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমানে রাশিয়া) গিয়েছিলাম। সেখানে বিশ্বযুদ্ধে আত্মবলিদান করা সেনাদের একটি সমাধি পরিদর্শনের সুযোগ হয়। সেখানে রাখা মন্তব্য বইতে লিখতে গিয়ে পাতা উল্টাতে গিয়ে আমি অবাক। দেখতে পাই বাংলা অক্ষরে লেখা, “সোভিয়েত বাহিনীর সকল সদস্যদের প্রতি শুভেচ্ছা রহিলো–শেখ মুজিব, বাংলাদেশ।” এটি সোভিয়েত ইউনিয়নে সফর করা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা। আমি অবাক হয়েছিলাম, মুজিব ভাই নিজের পরিচয়ে লিখতে পারতেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তা না লিখে তিনি শুধু লিখেছিলেন “শেখ মুজিব, বাংলাদেশ”। এ ঘটনায় তার হিমালয়সম উচ্চতা প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ যে একই সুতোয় গাঁথা এ তারই সাক্ষ্য বহনে যথেষ্ট।’
বঙ্গবন্ধুর ওই লেখার নমুনা দেশে এনে জাদুঘরে সংরক্ষণ করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দেয়ার দাবি জানান আবু হোসেন। তিনি বলেন, এই লেখায় বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয় ও দেশপ্রেম সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে নতুন প্রজন্ম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের জন্য মিছিল করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন আবু হোসেন। প্রিয় নেতাকে এভাবে হারানোর আঘাত তাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি বলেন, ‘মুজিব ভাইকে যেভাবে কাছ থেকে দেখেছি, তা আজীবন আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় লিপিবদ্ধ থাকবে। আমার দেখা সেরা মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।’
এইচএ/এমকেএইচ