মেহেরপুরে এক সময় সাতটি সিনেমা হল থাকলেও এখন টিকে আছে মাত্র একটি। মেহেরপুর পৌরসভার তত্ত্বাবধানে মেহেরপুর সিনেমা হলটি বিনোদনের খোরাক পূরণের চেষ্টা করছে। তবে চলচ্চিত্র শিল্পে ধসের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া হলগুলোর জায়গায় মার্কেট, বাগান, গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জানা যায়, জেলা শহরে মেহেরপুর হল, নীলমনি, প্রান্তিক, প্রতিভা; মুজিবনগরের সোনালিকা; গাংনীর ডায়মন্ড ও বামুন্দীর রানা সিনেমা হল দর্শকে মুখর ছিল। এরমধ্যে মেহেরপুর হলটি টিকে থাকলে দর্শক নেই। ফলে দিনের পর দিন লোকসান গুণতে হচ্ছে মালিকদের। অন্যদিকে বামুন্দীর রানা সিনেমা হলের অবকাঠামো থাকলেও পর্দায় ওঠে না কোনো সিনেমা। বাকি পাঁচটি হলের অস্তিত্বই নেই।
মেহেরপুর বামুন্দির দর্শক মিজানুর রহমান বলেন, ‘একটা সময় বাংলা সিনেমার সোনালী দিন ছিল, ঐতিহ্য ছিল। তাই বাবা-মায়ের বকুনি, আর চাচা ও বড় ভাইয়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হলে গিয়ে ছবি দেখতাম। সিনেমার ডায়ালগ মুখস্থ করে বন্ধুদের শোনাতাম।’
তমিজ উদ্দিন নামের আরেক দর্শক বলেন, ‘জীবনে এত ছবি দেখেছি যা হিসাব করে বলতে পারবো না। একটা সময় ছিল যখন শুধুই সিনেমা দেখতাম।’
মেহেরপুরে সবচেয়ে বেশি সিনেমা হল পরিচালনাকারী বশির উদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আক্তার ইমাম বিহারী নামে এক সিনেমা হল মালিক মেহেরপুরের মূখার্জী পাড়ায় নীলমনি হল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর চলচ্চিত্র প্রযোজক ফারুক ঠাকুর মেহেরপুর প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিভা সিনেমা হলটি। পরে ফারুক ঠাকুর নীলমনি সিনেমা হলটি আক্তার ইমামের কাছ থেকে কিনে নেন।’
১৯৮০ সালের দিকে শহরের কোর্টপাড়ার মুক্তার মহুরি মেহেরপুর শহরের ফুড গোডাউন পাড়ায় নির্মাণ করেন প্রান্তিক সিনেমা হল। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা খন্দকার আমিরুল ইসলাম পালু ১৯৮৩ সালে গাংনী উপজেলা শহরে নির্মাণ করেন ডায়মন্ড সিনেমা হল। অনেক আগেই নীলমনি ও প্রান্তিক সিনেমা হল ধ্বংস হলেও বাকিগুলো ২০০০ সালের পরে বন্ধ হয়ে গেছে।
মুজিবনগরের সোনালিকা সিনেমা হলের মালিক রেজাউল হক জানান, ১৯৮২ সালের দিকে বাংলা সিনেমা একটি অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল। ওই সময় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ হলে সিনেমা দেখতেন। এ সময় আমরাও মেহেরপুর, নীলমনি, প্রতিভা ও প্রান্তিক সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতাম।
তিনি আরও বলেন, তখন সিনেমা হল দর্শকে কানায়-কানায় পূর্ণ থাকতো। হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। সে কারণে ৯০ দশকের দিকে বল্লভপুর মোড়ে সোনালিকা সিনেমা হল নির্মাণ করি। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে অশ্লীলতা ও মানসম্মত কাহিনীর অভাবে দর্শক কমতে থাকে। সেই যে দর্শক কমতে লাগলো আর তাদের হলমুখি করা যায়নি। এক পর্যায়ে হলটি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হই।’
বামুন্দীর রানা সিনেমা হলের মালিক মামুনুর রশীদ বলেন, আমার বিশ্বাস বাংলা সিনেমার অতীত গৌরব আবারও ফিরে আসবে। আগেকার দিনের সেই সিনেমা পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রয়েছেন। তারা ভূমিকা নিয়ে রুপালী পর্দার সেই সোনালী দিন ফিরে আসবে। সে আশায় আমার হলটি বন্ধ রাখলেও সেটি ধ্বংস করিনি।’
মানসম্মত চলচ্চিত্রের অভাবে দর্শকরা হলবিমুখ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিনেমা হলের ব্যবসা মন্দা। চাহিদা অনুযায়ী এবং মানসম্মত ছবি না পাওয়া গেলে হলের যতই উন্নয়ন হোক না কেন, কোনোভাবেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একদিকে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, অন্যদিকে ভালো সিনেমা তৈরি না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’ হল মালিক শাহিনুর রহমান বলেন, ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সুস্থ চলচ্চিত্রের বিকাশ ঘটিয়ে হলবিমুখ দর্শকদের হলে ফেরাতে হবে। এজন্য বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল ফরম্যাটে সিনেমা বানাতে হবে। মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি করা গেলে দর্শকের অভাব হবে না।’
আসিফ ইকবাল/আরএইচ/জিকেএস