ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ছয় বছরে উন্নয়নের ছোঁয়ায় আমূল বদলে গেছে সেসব এলাকার চিত্র। বিলুপ্ত হওয়া ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের চরম দুঃখ-কষ্ট, বন্দিদশা আর নিগ্রহের সেই দিন এখন আর নেই। নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
আনন্দনগর, নতুন বাংলা, নগর জিগাবাড়ি ও নয়া বাংলা- নীলফামারীর এ সাবেক চারটি ছিটমহল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার রাস্তা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পরিবর্তন ঘটেছে দীর্ঘদিন বঞ্চিত হওয়া এসব মানুষের নাগরিক জীবন ব্যবস্থায়।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার বড় খারিজা আনন্দনগরের বাসিন্দা ময়মনা বেওয়া। ১৯০২ সালে জন্ম নেয়া ১১৯ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘আগে আমি ছিটমহলের বাসিন্দা ছিলাম। আমি এখন সেই আমি নই। আমি এখন বাংলাদেশের নাগরিক।’
ময়মনা জানান, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে তার দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়েছে। ৬৮ বছরের বন্দিজীবনের অবসানের পর সরকারের অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।
তার বড় ছেলে লাল মামুদ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মায়ের নির্দেশে অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পেয়েছি। মা সম্মাননা পেয়েছে।’
নগর জিগাবাড়ি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডে সংযুক্ত। বিলুপ্ত এই ছিটমহলটির বাসিন্দা মরহুম তছির উদ্দিনের ছেলে গোলজার হোসেন (৬০)। পেশায় দিনমজুর।
গোলজার হোসেন জানান, আগে আমার পরিচয় ছিল না। না বাংলাদেশি না ভারতীয়। পরিচয় গোপন করে চলতে হতো। আগে কোনো আইনি সহায়তা পেতাম না। আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। এখন সেদিন আর নেই। বদলেছে সবকিছু। এটি করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
একই এলাকার শাহজাহান আলী বলেন, আগে এ এলাকার জমি বিক্রি হতো কাগজে স্বাক্ষর করে। এর চেয়ে অন্য কিছু আর ছিল না। ৫ হাজার টাকায় শতক বিক্রি হয়েছে এখানকার জমি। এখন একই জমি ৩৫-৪০ হাজার টাকা শতকে বিক্রি হচ্ছে, রেজিস্ট্রি হচ্ছে। এর চেয়ে আনন্দের কী হতে পারে?
এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কুমলাই নদী। ব্রিজের অভাবে নদী পারাপার হয়ে আসা যাওয়া করতে হতো অন্য তিন ছিটমহলের মানুষকে। এখন সেই নদীর ওপর একটি ব্রিজ হওয়ায় সেই কষ্ট আর নেই।
সেখানকার বাসিন্দা রাসেল ইসলাম বলেন, পরিচয়হীন ছিলাম ছয় বছর আগে। এখন সে অবস্থা নেই। কুমলাই নদীটির নগর জিগাবাড়ি পয়েন্ট ব্যবহার করে চলাচল করতো তিন ছিটমহলের অনেক বাসিন্দা। ব্রিজ না থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে আমাদের। এখন আর সেই দুর্ভোগ নেই।
ওই এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা রাস্তাগুলো হয়েছে পাকা। আলো জ্বলছে বাড়ি বাড়ি। বিশুদ্ধ পানির জন্য বসেছে নলকূপ। হয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পন্নের জন্য হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার। ভিজিডি কার্ড, ভিজিএফ, সরকারি নানা প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা পাচ্ছে এলাকার মানুষ।
মনজিলা খাতুন নামের এক গৃহিণী বলেন, তখন তো কোনো আইন-কানুন ছিল না। পরিচয় গোপন করে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে হয়েছে। এখন আর শঙ্কা নেই, ভয় নেই। বৈধ নাগরিক হিসেবে সব সুবিধা নিতে পারছি।
২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের সঙ্গে একীভূত হন ডিমলা উপজেলার চারটি ছিটমহলের ১১৮৩ জন বাসিন্দা। এর আয়তন ১৬৮ দশমিক ৪৮ একর।
জটুয়া খাতা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মীম আকতার বলেন, এখন আমরা বাংলাদেশের মানুষ। নির্ভয়ে স্কুলে যেতে পারছি, পড়াশোনা করতে পারছি। এলাকায় আমার মতো অনেকে পড়ালেখা করছে। পরিচয় নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। আমরা পড়াশোনা শেষ করে ভালো কিছু করতে চাই।
জয়নাল আবেদীন (৭০) বলেন, আমি ১৬ শতাংশ জমি দিয়েছি সরকারকে। যাতে ভালো কিছু হয় এখানে। কিন্তু হয়েছে কমিউনিটি সেন্টার। এখানে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রয়োজন। এলাকার মানুষদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য বিশেষ কাজে আসবে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ২০২০ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নীলফামারী শিল্পকলা একাডেমির সম্মেলন কক্ষে অপরাজিতা নারী হিসেবে সাবেক ছিটমহলবাসী ময়মনা বেগমকে সম্মাননা প্রদান করেছিলাম। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই বৃদ্ধা ১১৯ বছর বয়সে আজ বিলুপ্ত ছিটমহলের এক জীবন্ত ইতিহাস!
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করে সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখন প্রয়োজন অনুসারে এলাকাগুলোর কাজ করা হচ্ছে। এলজিইডি থেকে বিশেষ একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণ এবং সড়ক সম্প্রসারণ ও মেরামত করা হবে। করোনার কারণে কাজটি শুরু হয়নি, তবে শুরু হবে দ্রুত।
১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তিটি বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে সেই ছিটমহল হারিয়ে গেছে। নাগরিকরা পেয়েছেন তাদের পরিচয়।
জাহেদুল ইসলাম/এমএইচআর/জেআইএম