ক্লাসের ৯ ছাত্রীর মধ্যে ৮ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। নবম শ্রেণিতে একমাত্র ছাত্রী এখন নার্গিস আক্তার। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সারডোব হাই স্কুলের খবর এটি। গ্রাম বা মফস্বলের স্কুলগুলোর কম-বেশি চিত্র এমনই। যে কলমে খাতা-কাগজ বা পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর লেখার কথা, সেই কলম চলেছে কাবিননামায়।
ঘন্টা বাজলেও গ্রামের এবং শহরতলীর নিম্ন-নিম্নমধ্যম পর্যায়ের পরিবারের সন্তানরা পড়ে– এমন স্কুলগুলোর অবস্থা কদ্দুর জানি আমরা? ছাত্র বিশেষ করে শিশু ছাত্রীদের ঝরে পড়ার কী নিষ্ঠুর কাব্য রচনা হচ্ছে? শিক্ষার চেয়ে বিয়ের আবশ্যকতায় বাল্যবিয়েতে ঝরে গেছে কতো মেধাবী ছাত্রী! এই মহামারিতে কতো কন্যাশিশুর বিয়ে হয়ে গেছে?- একটি কার্যকর জরিপ কী হতে পারে না? করোনার ঝড়ে টানা ৫৪৪ দিন তালা ঝোলার পর স্কুল-কলেজে ঘন্টা বাজার খবরগুলো গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। পাওয়ারই কথা।
কুড়িগ্রামের নার্গিসের ৮ বান্ধবীর মতো ছাত্রীরা যে শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে স্বামীর হাত ধরে চলে গেছে সেই হিসাব-জরিপ আছে? তারা এখন বধূ-সংসারী। ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা ছাড়াও শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সারাংশ হচ্ছে- ফের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু হলেও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফেরেনি। এই না ফেরাদের মধ্যে ছাত্রীই বেশি। করোনার কারণে কতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে সেই পরিসংখ্যানও নেই। শহরাঞ্চলের ভাগ্যাহত অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। সামর্থ্য না থাকায় সেখানেও সন্তানদের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে পারেনি।
পারিবারিকভাবেই শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আমার। নিজে যুক্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মক্তব-মাদ্রাসা মিলিয়ে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বর্তমান শিক্ষাবর্ষের শুরুতে যখন পাঠ্যপুস্তকের চাহিদায় খরা দেখছিলাম বিস্ময়ের চেয়ে উদ্বিগ্ন বেশি হয়েছি। বইয়ের চাহিদা কমে যাওয়ার বার্তাটি বড় খারাপ। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হিসাব করেই প্রতি বছর প্রাক্প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের বই ছাপানো হয়। চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে সরকার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ পাঠ্যবই ছেপে বিতরণ করেছে। তবে আগামী ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৩১৩ কপি বই ছাপার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবি। সেই হিসাবে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবই কমছে ৭৭ লাখের বেশি। এ সংখ্যা কী বার্তা দিচ্ছে? জরুরিভাবে বিবেচনায় নেয়া উচিৎ।
স্কুল-কলেজ খোলার সঙ্গে-সঙ্গেই অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে একটি খারাপ সংকেত বোধ করছি। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আলামত দিবালোকেই। অনেক শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে না আসা, শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখা এবং এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ না করার সারমর্ম বড় খারাপ। সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের হিসাব বের করা সহজ। আবার তারা ঝরে পড়ার একটা ব্যাকরণ ফলো করে। তাদের সংজ্ঞায় কমপক্ষে এক বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে না হলে কাউকে ঝরে পড়া হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না।
এই সংজ্ঞায় করোনায় ঝরে পড়ার অংক মিলবে না। বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের ৬৬ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর হিসাবই যথেষ্ট নয়। সারাদেশে ৬৪ হাজার কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে ৪০ হাজারই করোনার জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। শিশু তথা প্রাথমিক শিক্ষার একটা বিরাট জোগান প্রায় ৩০% কিন্তু তারাই দেন। সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। এর অন্তত অর্ধেক করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলোর শিক্ষক ও স্টাফরা না খেয়ে, একবেলা আধপেটা খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। গত বছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এক দিনও ক্লাসে বসতে পারেনি।
অটো পাস, ব্রেক অব স্টাডি, পরীক্ষা স্থগিত, ফলাফল বাতিল, সেশনজট ইত্যাদির সঙ্গে এদেশ একেবারে অপরিচিত নয়। তা পরাধীন পাকিস্তান জমানা ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেও। এর অভিজ্ঞতাটা বড় বেদনাদায়ক। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় ডিগ্রি পরীক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। পরে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। লোকে তাদের ‘পার্টিশন গ্র্যাজুয়েট’ বলে বিব্রত করত। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬১ সালের জুন পর্যন্ত ১৮ মাস এ অঞ্চলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল শরিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জানুয়ারি-ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাই-জুন সেশন পরিবর্তনের কারণে।
’৬১-তে আইয়ুব খানের মত পাল্টালে জানুয়ারি-ডিসেম্বর সেশনে ফিরতে তাদের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হয়েছিল মাত্র নয় মাস করে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক দিয়ে আবার ফিরতে হয় আগের নিয়মে। ওই সময়টায় মাঝখান থেকে একটি ব্যাচের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষকে ‘অটোপাস’ দেওয়া হয়। বিএ, বিএসসি এবং বিকম হয়ে পরে তাদের গঞ্জনা সইতে হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছরের ক্যারিকেচারও এ দেশের শিক্ষাজগতের ইতিহাসের অংশ। সত্তরের নির্বাচনের আগে-পরের ঘটনাও অনেক। একাত্তরের কাহিনি ঊল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।
বাহাত্তরের ঘটনা চরম কলঙ্কের। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে অটোপাস দেওয়া হয়। একাত্তরের প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষা হয় বাহাত্তরে। এরই মধ্যে সৃষ্ট সেশনজট এড়ানোর জন্য ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দুটি ব্যাচকে একত্রিত করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের গ্রিডলক থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে টানা দুই যুগ। এবারেরটি অনিবার্য হলেও ফল কিন্তু আরো খারাপও হতে পারে।
গত একদশকে শিশু শ্রেণি থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে কী বিশাল অর্জন আমাদের! প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এই দুই স্তরে বিনামূল্যে পাঠ্যবই, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিংসহ নানা উদ্যোগ কী সুফলই না দিচ্ছিল। শিক্ষার্থী এনরোলমেন্ট বেড়েই চলছিল। ঝরে পড়ার হার ছিল একদম হাতে গোনা। করোনা নামের মহামারি সব তছনছ করে দিল। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কি নেবো না? শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিয়ে, অপুষ্টি, শ্রমঘন কাজে শিশুদের জড়িয়ে পড়া আগামীর জন্য ভয়ঙ্কর বার্তা দিচ্ছে। শিক্ষায় বড় বিনিয়োগ জরুরি। শিক্ষাকে মেঘা প্রকল্পের আওতায় না আনলে গত এক দশকের অর্জন বিসর্জনে রূপ নিতে দুই বছরই যথেষ্ট।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস