নাটোরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বীজ ডিলার নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। উপঢৌকনের বিনিময়ে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ডিলারশিপ দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন ডিলার নিয়োগ থেকে বঞ্চিত অর্ধশত ব্যবসায়ী।
এ নিয়ে রোববার (৩ অক্টোবর) সকালে নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা।
তাদের অভিযোগ, ২০২১-২২ অর্থবছরে বীজ ডিলার লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন বীজ ডিলার নিয়োগে আমরা আবেদন করি। ২৯ জুলাই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) জরুরি সভায় ডিলার নিয়োগের সময়সীমা একমাস বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু যাচাই-বাছাই না করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে বিএডিসির রাজশাহী বিভাগীয় যুগ্ম-পরিচালক (বীজ বিপণন) দেলোয়ার হোসেন, উপ-পরিচালক (আলু বীজ) হাসান তৌফিকুর রহমান, সিনিয়র সহকারী পরিচালক (বীবি) এইচ এস জাহিদুল ফেরদৌস, উপ-পরিচালক (বীজ) জুলফিকার আলীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়।
তারা আরও বলেন, নাটোরের সাত উপজেলার ৫২ ইউনিয়নে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে ১১০ ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়। বিএডিসির নাটোর জেলার সিনিয়র সহকারী পরিচালকের (বীজ) দপ্তরে কর্মরত উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের বিনিময়ে বীজ বিক্রয় কেন্দ্র এবং সংরক্ষণাগার না থাকার পরও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী সশরীরে ডিলারদের দোকান এবং গুদাম সরজমিনে পরিদর্শনের কথা থাকলেও তিনি উৎকোচের বিনিময়ে অফিসে বসে পছন্দের ব্যক্তিকে ডিলার নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেন।
নাটোর শহরের নিচাবাজারের মেসার্স এষা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আরিফ খাঁনের কোনো দোকান নেই । তবুও তাকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিএডিসির বীজ ডিলার নিয়োগ করা হয়েছে। স্থানীয় কৃষক বা বীজ ব্যবসায়ীরা ওই ডিলারের নাম পর্যন্ত শুনেননি ।
রোববার শহরের নিচাবাজারে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে মেসার্স এষা এন্টারপ্রাইজে নামে কোনো দোকান খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই নামে বীজ ডিলারের কোনো দোকান ওই বাজারে কোনোকালেই ছিল না।
এ বিষয়ে আরিফ খাঁন বলেন, আমার বড় ভাই নাটোর জেলা বিএডিসি বীজ ডিলার সমিতির সভাপতি আসিফ খাঁন আমার নামে ডিলারশিপের লাইসেন্সটি করেছে। তিনি ভালো বলতে পারবেন প্রতিষ্ঠানটি কোথায়।
সদর উপজেলার পাইকারদল গ্রামে গিয়ে কথা হয় সিনথিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক সোহানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি অকপটে স্বীকার করেন তার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। তবে অচিরেই বিক্রয় কেন্দ্র চালু করবেন।
একইভাবে শহরের হরিশপুরের ভাইবোন এন্টারপ্রাইজ, চকরামপুরের আসাদুজ্জামানের দুই ভাই বীজ ভান্ডার, বনবেলঘড়িয়া এলাকায় উম্মে সায়মা রুনার মেসার্স সায়মা এন্টারপ্রাইজ, সদর উপজেলার বাকশোর ঘাট মতিউর রহমানের ছমিরন এন্টারপ্রাইজ, পাইকোরদল গ্রামের সোহানুর রহমানে সিনথিয়া এন্টারপ্রাইজ, বড়াইগ্রাম উপজেলার বাহিমালী হারোয়া বাজারে দলিল লেখক মশগুল আজাদের বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স, গোপালপুর ইউনিয়নে রাজাপুর বাজারে মো. আসাদুল ইসলামের মালিকানাধীন শুভ ট্রেডার্স, সিংড়া উপজেলার বিলদহর ইউনিয়নের ওষুধ বিক্রেতা আশিকুল ইসলামের মের্সাস আছিয়া ট্রেডাসসহ জেলার অধিকাংশ নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ডিলার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরজমিনে প্রতিটি এলাকায় ঘুরে এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বীজ ব্যবসায়ী তোহরাব হোসেনের অভিযোগ, মূলত স্বজনপ্রীতি এবং মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের বিনিময়ে এসব ডিলার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তো দূরের কথা এদের অধিকাংশ বীজের ব্যবসার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে স্বজনপ্রীতি এবং উপঢৌকনের বিনিময়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে অব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটি সুপারিশের জন্য নেওয়া হয়েছে ৫০ খেকে ৬০ হাজার টাকা। আর লাইসেন্সের জন্য হেদায়েততুল্লাহ খোকনকে দিতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ফলে কৃষকের জন্য বরাদ্দ বীজ খোলাবাজারে বিক্রিসহ অনিয়ম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোর জেলার সিনিয়র সহকারী পরিচালকের (বীজ) দপ্তরে কর্মরত উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, সরজমিনে পরিদর্শন করেই বেশিরভাগ ডিলারের নামে লাইসেন্সের সুপারিশ করেছি। তবে অনেকের বিক্রয় কেন্দ্র বা বীজ সংরক্ষণাগার নেই এটাও সত্যি। আমি সবাইকে খুশি রাখার জন্যই প্রতিটি ডিলারের আবেদনে স্বাক্ষর করেছি।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বিএডিসির রাজশাহী বিভাগীয় যুগ্ম-পরিচালক (বীজ বিপণন) দেলোয়ার হোসেন, উপ-পরিচালক(আলু বীজ) হাসান তৌফিকুর রহমান, সিনিয়র সহকারী পরিচালক (বীবি) এইচ এস জাহিদুল ফেরদৌস, উপ-পরিচালক (বীজ) জুলফিকার আলী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা হেদায়েতুল্লাহ খোকনের নম্বরে একাধিকবার ফোন করেও বন্ধ পাওয়া যায় ।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, বীজ ডিলার নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি । তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেজাউল করিম রেজা/এসজে/জিকেএস