বিশেষ প্রতিবেদন

সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

বীর প্রতীক এম এ হালিম। তিনি দোয়ারা বাজার সুরমা ইউনিয়নের টেংরাটিলা গ্রামের প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস ও জোবেদা খাতুনের ছেলে। ১৯৭১ সালে সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এলাকার কয়েকজন ছাত্র-যুবককে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধের নানান স্মৃতি নিয়ে জাগোনিউজ২৪.কম-এর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি লিপসন আহমেদের সঙ্গে কথা হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।

জাগো নিউজ: কখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন?

এম এ হালিম: বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, পাকিস্তানিরা সহজে আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এই ক্ষমতা পেতে হলে আমাদেরকে তাদের সঙ্গে শক্তি প্রয়োগের লড়াই করতে হবে। সেই থেকে আমি মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তারপর ২৫ মার্চের কালরাত্রির ঘটনা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। যে গণহত্যা হয়েছিল, সেই গণহত্যার পর তরুণ-যুবক সবার মনেই একটা ধারণা জন্মেছিল যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু যখন বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই ভাষণ থেকে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই করেই এই দেশকে স্বাধীন করতে হবে।

জাগো নিউজ: শুরুর দিকে মনোভাব কেমন ছিল বা যুদ্ধে যেতে কেউ বাধা দিয়েছিল কি না?

এম এ হালিম: শুরুর দিকে আমার মনোভাব একটুও পরিবর্তন হয়নি। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন, তা আমার ছিল। কেউ আমাকে বাধা দিয়ে আটকাতে পারবে না, তেমন সংকল্প আগেই ছিল। আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। উনারা আমাকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে দেখলেন, আমি সিদ্ধান্তে অটল। দেশের জন্য, মানুষের জন্য জীবন-বাজি রাখবো। তারপরও পাকিস্তানিদের এই দেশ থেকে বিতাড়িত করবো।

জাগো নিউজ: তখনকার প্রতিটি মুহূর্তই ছিল ঝুঁকির্পূণ। এমন কোনো ঘটনা আছে, যা আজও আপনার মনকে শিহরিত করে?

এম এ হালিম: প্রতিটা মুহূর্তই আমাদের জন্য ঝুঁকির্পূণ ছিল। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়কার কথা। আমি যখন প্রথম যুদ্ধে যাই, তখন আমরা ভারতের সেনাবাহিনীর আওতায় ছিলাম। তাদের কথা অনুযায়ী যুদ্ধ করতে হবে। প্রথমে যুদ্ধের যে নিয়ম ছিল সেটা ছিল গেরিলা পদ্ধতি। আসলে গেরিলা পদ্ধতি যে যুদ্ধটা সেটা হলো ‘হিট অ্যান্ড রান’। আঘাত করো, চলে আসো। আমরা সে পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে দেখলাম দেশ স্বাধীন করা সম্ভব না।

হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে তাদেরকে মারলাম। পাকিস্তানি কিছু নিহত হলো, আমরাও আহত হলাম। এমন অবস্থায় দেশ আমরা দখল করতে পারবো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় ছিল। তবে মনোবল ছিল দেশ স্বাধীন হবেই। এই পদ্ধতিতে যুদ্ধে সময় লাগতে পারে বেশি। তাই আমরা সম্মুখযুদ্ধের প্রস্তুতি নিলাম। সেই সম্মুখযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার একটা সফলতা হলো তখন সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার আমাদের গাইড করতে শুরু করলেন এবং বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হলো। আমরা ৫ নম্বর সেক্টরে পড়লাম। এই সেক্টরে কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী।

কয়েকটা সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। সাব-সেক্টরের কামান্ডার ছিলেন তখনকার ক্যাপ্টেন হেলালসহ অনেকেই। ফলে এই সব সাহসিক অফিসারের অভিযানে আমরা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করতে পেরেছি। তারপর আমাদের ওপর অর্ডার আসলো, তোমরা শত্রুদের যা যা রাস্তাঘাট আছে, সবকিছু বন্ধ করে দাও। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিলাম। প্রথমে সুনামগঞ্জের জাওয়ার ব্রিজ ডাবর ফেরি এই দুটি একদিনে পুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলাম। কোন কোন দিকে পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যাবো, সেই নকশাও তৈরি করলাম।

নকশা তৈরি করে সেখানে আমরা আঘাত করার ব্যবস্থা নিলাম এবং কীভাবে আঘাত করবো সেই রকম পরিকল্পনা নিলাম। সেভাবে আমরা ট্রেনিং দিয়েছি এবং নিয়েছি। আমাকে প্রথম পাঠানো হলো সুনামগঞ্জের জাওয়া সেতু। আমার সঙ্গে আরও দুজন ছিল। বয়স তখন ২২ বছরের মতো হবে। আমাকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে কুলি সাজানো হলো। দুই মুক্তিযোদ্ধাকে মাদরাসাছাত্র সাজিয়ে তাদের সঙ্গে কুলি হিসেবে জাওয়া সেতু রেকি করতে যাই।

সেতুর ওপর গিয়েই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা তর্কাতর্কি শুরু করি। এসময় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা আমাদের কাছে এসে জানতে চায়, কী হয়েছে? ছাদ্মবেশি দুই মুক্তিযোদ্ধা আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই কুলির বাচ্চা বলেছিল, মালপত্র নিয়ে মাদরাসা পর্যন্ত যাবে। এখন মাঝপথে এসে বলছে, যাবে না।’ এর ফাঁকে আমি পুরো সেতু রেকি করে ফেলি। পাকিস্তানি সেনারা আমাকে গালাগালি করতে লাগে এমনকি হত্যার ভয় দেখিয়ে মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়। পরদিন সেতুটি আমরা ধ্বংস করি এই কথাগুলো মনে হলে। শরীরটা শিহরিত হয়।

জাগো নিউজ: বিজয়ের প্রাক্কালে আপনি যেখানে দায়িত্ব পালন করতেন, সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি কেমন ছিল?

এম এ হালিম: বিজয়ের প্রাক্কালে আমি সুনামগঞ্জের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় ছিলাম। বেশ কয়েকটা কোম্পানি সেখানে গিয়ে পাকিস্তানিদের ঘেরাও করেছি। আমরা তাদের ঘেরাও করেছি, সেই খবরটি পাকিস্তানিরা পেয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ শুরু করেছে। এমনকি প্রচুর বোম্বিং হচ্ছিল, বোমাগুলো এসে আমার একটু আগে পড়ছিল। এমনভাবে বোম্বিং হচ্ছিল সেই বোমাগুলো পাকিস্তানিদের উপর গিয়ে পড়ছিল। তবে আমাদের সঙ্গে এর আগে ভারতের কোনো বাহিনীর লোক ছিল না। ভাবলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারত বোধহয় আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসছে। আসলে তা না। এই বোম্বিংগুলো ছিল পাকিস্তানের এবং সেগুলো তাদের ওপর গিয়েই পড়ছে। এরপর পাকিস্তানিরা শুকনা একটা খালের মধ্যে বসে পড়লো। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলাম কম, এমনকি তাদের মতো আমাদের হাতিয়ারও ছিল না।

আমি একটা কোম্পানির দায়িত্বে ছিলাম এবং আমার কোম্পানির সহযোদ্ধা আবদুল লতিফ রাতভর যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে যুদ্ধের একসময় রাতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। ভোরে অস্ত্রসহ ধরা পড়েন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। লতিফকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য দেখছে সাধারণ মানুষ। আর আমি সাধারণ মানুষের কাতারে। লতিফ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পাল্টা আক্রমণ করে যে তাকে উদ্ধার করবো, সেই উপায়ও নেই। সেদিন তাকে রক্ষা করতে পারিনি।

হঠাৎ করে শুনি ভারত থেকে যখন বলছিল, পাকিস্তানিদের জন্য এক জরুরি ঘোষণা তোমরা হাতিয়ার ফেলে দাও, আমাদের মুক্তিবাহিনী তোমাদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে। বারবার এই ঘোষণা আসছিল। তখন পাকিস্তানিরা পাগলের মতো হয়ে গেছে। এত দুর্বল হয়েছে আমার মনে হয়, গুলি না লাঠি দিয়ে আঘাত করলেই তারা এক-একটা মারা যাবে। মৃত্যুকে কে না ভয় করে! তখন আমরা পাকিস্তানিদের বললাম, আত্মসমর্পণ করার জন্য। কিন্তু পাকিস্তানিরা আমাদের বিশ্বাস করেনি। তারা তখন ভারতের সৈন্য খুঁজছিল তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য। কারণ তাদের যুদ্ধ চুক্তি, আত্মসমর্পণের চুক্তি সবকিছু জানা। তারা মনে করছে আমরা এসব জানি না। আসলেই আমরা এসব জানতাম না। তারা বুঝতে পেরেছিল, যা কিছুই তারা বলুক না কেন, আমরা তাদের গুলি করে হত্যা করবো। আমাদের জয় তখন চূড়ান্ত। শেষপর্যন্ত ভারতের সৈন্যদের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করলো। তখন আমরা চারদিক ঘেরাও করে রাখি। কারণ আমরা পাকিস্তানিদের বিশ্বাস করিনি। এটাই ছিল আমার যুদ্ধের শেষসময়ের কিছু স্মৃতি।

জাগো নিউজ: স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশকে নিয়ে কিছু বলুন?

এম এ হালিম: বিজয়ের ৫০ বছরপূর্তিতে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কিংবা পকিস্তানিদের পক্ষে যে সব বাঙালি ছিল, তাদের যে বিচার হয়েছে। তবে কেউ কেউ এখনো বাকি আছে। গ্রামেগঞ্জে যারা ছোট-খাটো পাকিস্তানি সর্মথক ছিল, তাদের তেমন একটা বিচার হয়নি। তবে বিশেষভাবে যারা পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের বেশ কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। তারপর বঙ্গবন্ধু হত্যা; তাদেরও বেশ কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। কয়েকজন পলাতক রয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। তবে উন্নয়নের ব্যাপারে আমরা যে রকম উন্নয়ন আশা করেছিলাম সোনার বাংলায়, বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ তিনবেলা পেটভরে ভাত খাবে, কাপড় পরবে, ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হবে। সবাই রুজি-রোজগার করতে পারবে এবং সুখী মানুষ থাকবে। সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন আমরা দেখছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়নি। তবে এখন আমরা উন্নয়শীল দেশে পরিণত হয়েছি। আমাদের টাকা দিয়ে আমরা রাস্তা-ঘাটসহ অনেক কিছু করছি। আমরা আশাবাদী খুব দ্রুত আরও উন্নত দেশে পরিণত হবে। এ দেশের মানুষ সুখ-শান্তিতে বসবাস করবে এই আমার প্রত্যাশা।

জাগো নিউজ: ভবিষৎ প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলুন।

এম এ হালিম: ভবিষৎ প্রজন্মের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। এখন ইয়াং জেনারেশন, বিভিন্ন অফিস আদালতে গেলে দেখা যায়, তারা অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে। পাকিস্তানি কায়দা ছিল অন্যরকম। এটা এখনো যে নেই, এমনটা না। তবে অচিরেই আমরা দেখবো, ভবিষৎ প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন অফিস, আদালত, গ্রামগঞ্জ, স্কুল-কলেজে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করবে।

জাগো নিউজ: আপনি একজন বীর প্রতীক এবং বর্তমানে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। তবে আপনার সুরমা ইউনিয়নটা খুব অবহেলিত, আপনার ইউনিয়ন নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

এম এ হালিম: বর্তমানে আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। সুরমা ইউনিয়নে বিগত ১৫ বছর ধরে কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমি চ্যালেঞ্জ করে এই নির্বাচনে আসছি। চ্যালেঞ্জ করে বলেছি, আমি এই সুরমা ইউনিয়নকে ঢেলে সাজাবো। কারণ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি নির্বাচিত হয়েছি। তাই আমার লক্ষ্যই হচ্ছে উন্নয়ন।

এএএইচ/এসএইচএস/জেআইএম