গিটার নিয়ে গান করছে ছোট্ট একটি ছেলে। বয়স সবেমাত্র ৮। গিটার ও তাকে পাশাপাশি দাঁড় করালে তার উচ্চতাই কম হবে। নিজের উচ্চতার চাইতে বড় গিটারের ওজনও হয়তো তার জন্য বয়ে বেড়ানোই কষ্টকর। কিন্তু, ওই গিটারের তারে ঢেউ খেলিয়ে সুরের মূর্ছনায় সবাইকে যেভাবে মাতিয়ে তোলে শিশুটি, মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
ওর নাম ঋতুরাজ। পড়াশোনা অস্ট্রেলিয়ান স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে।
যখন তার বয়স সবেমাত্র পাঁচ, বাংলা প্রতিটি শব্দ উচ্চারণেও তার মুখে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন থেকেই রবীন্দ্রসংগীত থেকে শুরু করে জেমস-আইয়ুব বাচ্চুসহ কালজয়ী তারকা গায়কদের গান গেয়ে মাতিয়ে তুলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সবেমাত্র দাঁত পড়ে ফাঁকা হয়ে আছে সামনের পাটি। সেই ফাঁক দিয়েই বের হয়ে আসছে সহজ থেকে কঠিন সব গান।
তার ওপর আবার গালভরা হাসি। ফোকলা দাঁতের হাসি আর নিজের উচ্চতার চাইতেও বড় গিটারে গান; একটু যেন বেশিই কিউট। তাই খুব সহজেই সে নজর কেড়েছে নেটবাসীদের। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, এই বয়সে ইতোমধ্যে গান গেয়ে মঞ্চ মাতিয়েছে বেশ কয়েকবার। একই মঞ্চে গান গেয়ে প্রসংশা কুড়িয়ে আদর পেয়েছে দেশের সব তারকাদেরও।
গানকে পাশাপাশি রেখে মূল জায়গায় থাকা পড়াশোনায়ও কম নয়। ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা। বাংলায় গান চর্চা করা। ক্লাসে ও পরীক্ষায় বরাবরের মতোই ভালো নাম্বার তার। সেই সঙ্গে এখনই তৈরি হচ্ছে কম্পিউটারের দক্ষতা। নিয়ম করে প্রতি দিনই কোডিংয়ের ওপর সময় দিচ্ছে এই বয়স থেকেই।
ছোট্ট শিশুটির এতসব গুণের পেছনে রয়েছেন তার বাবা শুভাশীষ ভৌমিক। পেশায় একজন প্রকৌশলী। শখের বসে নিজেও একজন ভালো গায়ক।
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বাপকা বেটা’ নামে একটি পেইজে হৃদয় খানের গাওয়া লক্ষ্মী সোনা গানটি বাবা-ছেলে একসঙ্গে গেয়ে আপলোড করেন। এর পর তাহসানের ‘আলো আলো’, অনুপমের ‘আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি’, নগর বাউলের ‘ছেলে আমার বড় হবে’, আয়ুব বাচ্চুর ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’ সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গান ভাইরাল হয় বাপকা বেটার কণ্ঠে।
এর পর থেকে বেড়েই চলছে বাপ-বেটা জুটির গল্পের পাতা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বাবা ও ছেলে সব সময় একই ধরনের জামা পরেন। বাবার টিশার্টে ছেলেকে মেনশন করে ও ছেলের টিশার্টে বাবাকে মেনশন করে কোনো উক্তি লেখা থাকে। ছেলের টিশার্টে কখনো লেখা থাকছে ‘বাবা হিরো’ আবার বাবার টিশার্টে লিখা থাকছে ‘ছেলে হিরো’। ব্যতিক্রমী এ বিষয়টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা তাদের পেজে সব সময় চোখ রাখছেন, সবারই নজর কেড়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা দেখে বুঝাই যায়, বাবা ছেলেকে খুব বেশি সময় দেন। ঘুরতে যাওয়া, কোথাও খেতে যাওয়া, ছেলেকে সামাজিক কর্মকাণ্ড শিক্ষা দিতে পথশিশুদের জন্য গিফট নিয়ে যাওয়া, ছোট ছোট ভালো কাজের শিক্ষা দিয়ে ছেলেকে গড়ে তুলছেন একজন স্বচ্ছ মানুষ হিসেবে। বাবা-ছেলের একসঙ্গে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া কিংবা ঘুরতে যাওয়া শুধুমাত্র বিনোদনই নয়, এর মধ্য দিয়ে দুজনের যে এক অনন্য বন্ধুত্ব গড়ে তোলা সম্ভব, ‘বাপকা বেটা’ সেই বার্তাই দেয়।
বাবা ছেলের এই বন্ধুত্বের গল্প পাঠকদের সামনে তুলে ধরছে জাগো নিউজ। ছোট্ট ছেলেটারও ‘স্মার্টনেস’ যাচাই করতে বাবার থেকে আলাদা করেই তাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তরও বাবার কাছ থেকে শুনতে হয়নি তার। গুছিয়ে প্রতিটি উত্তরই দিয়েছে সে নিজ থেকেই।
যেহেতু গান দিয়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পরিচয়। গানের প্রশ্নই তাকে আগে করা হয়েছিল। কার গান শুনতে ও গাইতে ভালো লাগে জানতে চাইলে ঋতুরাজের উত্তর, ‘শাফিন আঙ্কেল, তাহসান আঙ্কেল আর জেমস আঙ্কেলের গান গাইতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। ওনাদের গান শুনতেও ভালো লাগে।’
প্রতিদিনের কাজের নির্দিষ্ট রুটিন আছে ঋতুরাজের। যার কারণে সকাল থেকে রাতে ঘুমনোর আগ পর্যন্ত কোনো সময় নষ্ট হয় না তার। ঘুম, নাস্তা, পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক, দক্ষতা অর্জনে অনলাইনে বাড়তি কিছু শেখা, কোডিং ক্লাস, স্কুলে যাওয়া, বাবার সঙ্গে হাঁটতে কিংবা খেলতে যাওয়া, গান করা, নির্দিষ্ট বেধে দেওয়া কিছু সময় টিভি দেখা, পরিবারের সবার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটানোসহ সারাদিন কোনো না কোনো কাজের মধ্যেই সে ব্যস্ত। শুক্রবার ও শনিবার স্কুল বন্ধ। তাই ঘুমের সময়ও একটু বেশি পাওয়া যায়। সেই সময়টিকেও কাজে লাগায় ঋতুরাজ। ওই দুদিন ঘুম থেকে একটু দেরিতেই ওঠা হয়। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পরিবারের সবাই মিলে লুডু খেলতে যায়। সেই খেলাতে বেশির ভাগ সময় জিতে যান দাদু, তারপরেই নকি ঋতুরাজ। মাকেও হার মানিয়ে দেয় সে।
লুডু খেলা নিয়ে ঋতুরাজের বর্ণনা ঠিক এমনই, ‘প্রথমে আমি হেরে যেতাম বলে কান্না করে ফেলতাম। কিন্তু পরে বাবা আমাকে শিখিয়েছে যে, ‘হেরে গেলেও বারবার চেষ্টা করতে হয়’। এজন্য এখন আর আমি হারি না।’
ঋতুরাজের পছন্দের খাবার খাসির গোস্ত। পছন্দের খেলাধুলা ফুটবল ও ক্রিকেট। এছাড়াও নিয়মিত ভালো লাগার কাজগুলো জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘গিটার বাজানো, গান করা, আর্ট করা তারপরে আরও অনেক কিছু।’
এতগুলো কাজ করতে পার, তাহলে ক্যামেরার সামনে শুধু গান গাও কেন? তার ‘স্মার্ট’ উত্তর, ‘এটা বাবার ওপর ডিপেন্ড করে যে বাবা কী করবে। তবে আমার মনে পড়ে, আমি গানের পাশাপাশি দুই একবার ক্যামেরার সামনে আর্টও করেছি, লুডুও খেলেছি।’
ঋতুরাজের ইচ্ছা বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে সে। আর্মি অফিসার কেন হতে চাচ্ছ প্রশ্ন করলে কিঞ্চিত দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে তার উত্তর, ‘আসলে আমার অনেক কিছু হবার ইচ্ছা আছে। ফাইনালি কী হব এখনও ডিসাইড হয়নি। তবে ফুটবলারও হবার ইচ্ছা আছে।’
তবে আর্মি অফিসার হয়ে কি পাশাপাশি ফুটবলার হওয়া যায় না? এমন প্রশ্নে দ্বিধা থেকে বেরিয়ে আসে ঋতুরাজ। তাৎক্ষণিক উত্তর, ‘আমি একজন আর্মি অফিসারও হতে চাই। পাশাপাশি আমি অনেক কিছুই করতে চাই। গান গাইতে চাই ও ভালো ফুট বলার হতে চাই।’
বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চাইলে ঋতুরাজের উত্তর, ‘ক্লাস ফ্রেন্ড আছে ৩২ জন। এর মধ্য থেকে ক্লোজ ফ্রেন্ড ৫ জন। আমার বন্ধুদের মধ্যেও অনেকে গান গায়। আমার গান নিয়েও বন্ধুরা রিভিউ দেয়। বলে তোমার এই গানটা ভালো লেগেছে।’
তবে পরিবারের মধ্য থেকেই সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে খুঁজে নেয় সে। ঘরে ও বাইরে সবদিক মিলিয়ে সবচেয়ে ভালো বন্ধু কে জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘বাবা’। এর পরেই রয়েছে ‘দিদা’। যার সঙ্গে প্রতিদিন চলে লুডুর ম্যাচ ও নানা ধরনের বায়না।
বাবা কেন এত ভালো বন্ধু জানতে চাইলে ঋতুরাজের উত্তর, ‘বাবার সঙ্গে সাইকেল চালাই, গান গাই। বাবা আমাকে মাঝে মাঝে গিটার শিখায়। আমার গিটারের টিচার আছে, তবুও বাবার কাছে শিখি। মাঝে মাঝে আমরা ফুটবল খেলি, ক্রিকেট খেলি, আরও অনেক কিছু খেলি। বাবার সঙ্গে সাইক্লিংয়ে যাই, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। বাবা আর আমি একই ধরনের পোশাক পরি।’
একই ধরনের পোশাক পরতে কেমন লাগে জানতে চাইলে ঋতুরাজের উত্তর, ‘বাবা আর আমার একই ধরনের পোশাক পরতে ভালো লাগে।’ বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কটা এভাবেই বুঝিয়ে দিল সে, ‘আমি আমার বাবার কাছে হিরো, আমার কাছেও বাবা হিরো। তবে বাবার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতা হয়। গিটারের প্রতিযোগিতাও হয়।’
এত সব কাজের পাশাপাশি ভ্রমণও বেশ উপভোগ ঋতুরাজ। ঘোরাঘুরি করা হয় কিনা জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘বাবার সঙ্গে দেশের অনেক জায়গায় ঘুরা হয়েছে। রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা এসব জায়গায় গিয়েছি ঘুরতে। সব জায়গাই আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু বলতে গেলে, রাঙামাটিতে আমরা বেশি মজা করেছি।’
নিজের অধিকাংশ কাজ এখনই নিজে করতে শিখে গেছে ছোট্ট ঋতুরাজ। তার কথায়, ‘বাসায় সব কাজ একা একাই করা হয়। এছাড়া মা পড়াশোনায় হেল্প করে। নিজের হাতেই খাই। তবে রাতে মা খাইয়ে দেয়।’
ছোট হলেও আছে দায়িত্ব বোধ। বাবা খাইয়ে দেয় কিনা জানতে চাইলে তার উত্তর, ‘বাবা সকালে অফিসে চলে যায়। আবার রাতে যখন আশে, তখন টায়ার্ড থাকে। এজন্য খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ বাবাকে সকালে উঠতে হয়।’
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এখনকার বাচ্চাদের মধ্যে যেসব ক্ষতিকর প্রবণতা দেখা যায় তা ঋতুরাজের মধ্যে নেই। তার ভালো লাগার মধ্যে কার্টুন কিংবা মোবাইল আসক্তি এরকম কিছু নেই। খেলাধুলা ও পরিবার কিংবা বাবার সঙ্গে সময় কাটানোই তার ভালো লাগার বিষয়। ল্যাপটপে পারদর্শী। এই বয়সেই কোডিং শিখছে সে।
ঋতুরাজের মুখ থেকেই তার সম্পর্কে বেশ জানা হলো। এবার ছেলের সম্পর্কে জানতে চাইলে বাবা বলেন, ‘নিজের কাজ নিজে শিখে গেছে। তবে কাপড় চোপড় পরার জন্য মাঝে মাঝে দাদুর কাছে বায়না করে। নাতির এমন বায়নায় দাদুও বেশ মজা পান। কিন্তু আমি যখন বাসায় থাকি, তখন সব কাজ ওকে দিয়েই করাই। নিজের হাতেই খেতে বলি। প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে ও নিজে চিন্তা করে। আমি ওকে সেই সুযোগ দেই।’
‘বাপকা বেটা’ পেইজ সম্পর্কে জানতে চাইলে শুভাশীষ ভৌমিক বলেন, ‘বাপকা বেটা পেইজের পেছনে তেমন কোনো উদ্দেশ্য নেই। শুধুমাত্র আমার ছেলের সঙ্গে আমার যে সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটছে, এগুলো ধরে রাখা। এখন যেহেতু উন্নত প্রযুক্তির যুগ, তাই আমি এসব স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখছি। আমি যদি বাপকা বেটা পেজ নাও খুলতাম, তবুও আমি আমার ছেলের সঙ্গে এভাবেই সময় অতিক্রম করতাম। আমি ক্যামেরার সামনে ও পেছনে ছেলের সঙ্গে একইভাবে আচরণ করি। এমনটা নয় যে, আমি ভিডিও বানানোর জন্যই ছেলের সঙ্গে এত সুন্দর মিশে যাই।’
তিনি বলেন, ‘বৈজ্ঞানিকভাবেই পরীক্ষিত যে, মানুষের মধ্যে যদি ‘সাবকনসাস মাইন্ড’ তৈরি করা যায়, তবে তার প্রতিটি বিষয় খুব মনে থাকবে এবং প্রভাব পড়বে। আমি ঋতুরাজের সঙ্গে গানের মাধ্যমে বন্ধুত্ব করে তার সঙ্গে জীবনের প্রতিটি কাজ করি। তার সঙ্গে সম্পর্ক করে নিয়েছি। আমি যদি তাকে প্রতিটা কাজের জন্য আদেশ নিষেধ করতাম, তাহলে হয়তো তার খারাপ প্রভাবও পড়তে পারে। এজন্য ‘সাবকনসাস মাইন্ড’ কাজে লাগিয়ে গানের মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে আমি যে সম্পর্ক করছি, তাকে দিয়ে আমার বেস্ট প্র্যাক্টিসট করাচ্ছি, সেও এটাকে ভালোভাবেই মানিয়ে নিচ্ছে।’
ছেলেকে গান শেখানো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘরোয়া পরিবেশে যতটুকু করা যায়, আমি সেটুকুই চেষ্টা করছি। নিজে নিজেই ধীরে ধীরে ঘরে বসে করছি। আমি ওকে কোনো কিছুই দক্ষতা করার জন্য শিখাচ্ছি না। একদম গানের মধ্যে তাকে ঢুকিয়ে দিচ্ছি না। নিজের খেয়াল খুশি মতো সে শিখছে। তার সৃজনশীলতা থেকে সে শিখে নিচ্ছে।’
ছেলেকে কীভাবে ব্যবহারিক জীবনের শিক্ষা দিচ্ছেন এবং বাবা ছেলের সম্পর্ক কীভাবে তৈরি করছেন এ নিয়ে জানতে চাইলে শুভাশীষ বলেন, ‘আমি আমার ছেলের সঙ্গে রাগারাগি কিংবা তার সামনে কখনও কোনো খারাপ ভাষা ব্যবহার করি না। যদি পরিবারের কোনো অসঙ্গতি থাকে, পরিবারের অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা হলেও আমরা ওর সামনে বলি না। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমরা একটু আরাম করে বসার জন্য অনেক সময় চেয়ারের ওপর পা তুলে বসি। যেটা দেখতে খারাপ দেখা গেলেও বাসায় কিংবা খাবার টেবিলে মাঝে মঝেই এভাবে বসে থাকি। কিন্তু আমি কখনও আমার ছেলের সামনে ওভাবে বসি না। কারণ আমি একদিন নিজের অজান্তে চেয়ারের ওপর পা ভাঁজ করে বসেছিলাম। তখন দেখি সেও আমাকে ফলো করছে। আমি তাকে অনেকবার সোজা হয়ে বসার জন্য বললাম। কিন্তু সে মানছিল না। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমার প্রতিটি বিষয় আমার ছেলের মধ্যে অবচেতনভাবে ঢুকে পড়ছে। আমি বিষয়টা খেয়াল করার পর আর কখনও নিজের অজান্তেও এভাবে অসচেতন হয়ে বসি না। এতটুকু সচেতনতাও আমি অবলম্বন করি। তার মধ্যে যেন খারাপ কিছু না ঢুকে পড়ে এজন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
বাপকা বেটা পেজের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অনেক মানুষ দেখছে। বিষয়টা নিয়ে আর কী কী করছেন? জানতে চাইলে শুভাশীষ বলেন, ‘আমার চেষ্টা ছিল কীভাবে ছেলের সঙ্গে আমার আচরণ ও সম্পর্কের ব্যাপারটা আরও পরিমার্জিত করা যায়। আমি যখন পেজটা খুললাম। তখন দেখতে পেলাম মানুষ খুব সুন্দর রেসপন্স করছে। প্রচুর মানুষের ভালোবাসা আসতে শুরু করল। চিন্তা করলাম, এখান থেকেই ভালো কিছু হতে পারে। মানুষও আমাদের থেকে ইনস্পায়ার হচ্ছে। অনেক মানুষও আমাদের কার্যক্রম দেখে নিজেরাও চেষ্টা করছে। তখন আমার ভালোলাগাও কাজ করল। আমার মধ্যে দায়িত্ববোধও জাগলো যে, যেহেতু বিষয়টা শুধু আমার আর আমার ছেলের মধ্যে সিমাবদ্ধ নেই। এখন অনেক মানুষ আমাদেরকে দেখে। তাহলে আরও বেশি পরিমার্জিত হওয়া দরকার। তাই আরও বেশি সচেতন হয়ে ও দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজগুলো করি।’
ছেলেকে নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী? শুভাশীষ ভৌমিক বলেন, ‘অনেক বাবা মায়েরই পরিকল্পনা থাকে, ছেলে কী হবে। এধরনের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। আমার কাছে মনে হয়েছে এমন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, যার মধ্যে প্রতিনিয়ত জানার ইচ্ছা থাকবে, নতুন কিছু করার চেষ্টা থাকবে, নিজেকে প্রতিটা সেক্টরে ডেভেলপ করে সমাজকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবে। আমার কাছে মনে হয়েছে, সবচেয়ে ভালো জায়গায় পড়াশোনা করে সবচেয়ে ভালো চাকরি করার চাইতে সমাজে প্রভাব পড়বে এমনভাবে মানুষের জন্য কিছু করা।’
আমাদের সমাজে সন্তানদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বেশ প্রবণতা রয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। তবে তার থেকে একদমই ব্যতিক্রম ঋতুরাজ ও তার বাবার গল্প। শুভাশীষ বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে প্রফেশনালভাবে গান শেখানোর জন্য শিক্ষা দিইনি। আমি তাকে একটা গানও মুখস্ত করাইনি। যখন থেকে ও গান করে, আমি কিন্তু চাইলে ওকে গানের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে পারতাম। আমি ঋতুরাজকে গানের স্কুলে নিয়েও গিয়েছিলাম। দুই দিন পর আর সে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। আমি তখন বুঝতে পেরেছি যে, তাকে এভাবে শেখানো যাবে না। তার আগ্রহের জয়গা হলো বাবা। আমাকে কেন্দ্র করে তার সব আগ্রহ। আমার জিনিসগুলো তার ভালো লেগেছে। আমিও সেভাবেই তার মধ্যে আগ্রহ তৈরি করছি। তার ভালো লাগার বাইরে আমি তাকে কিছুই চাপিয়ে দেইনি। কেউ যদি তার সন্তানকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখেন, সন্তানকে বড় হয়ে কী হিসেবে দেখতে চান, তাহলে সন্তানের মধ্যেই সেই আগ্রহটা তৈরি করার সুযোগ দিতে হবে। নিজের মধ্যেই সে জিনিসটা চর্চা করতে হবে। সন্তানকেও বুঝে ওঠার সুযোগ দিতে হবে।’
নিজের পেশাগত কাজের পর বাকি সময় সন্তানকেই দেন কিনা? শুভাশীষ বলেন, ‘আমি কাজের পর ছেলেকেই যে সময় দিচ্ছি বিষয়টা এমন না। আমি বাইরেও সময় দেই। কাছের কিংবা পরিচিত সবার সঙ্গেই সময় দেই। ছেলের জন্য সময় বেধে দিচ্ছি বিষয়টা এমন না। তবে পরিবারকে একটু বেশি প্রাধান্য দেই।’
বাবা ছেলে একই ধরনের পোশাক পরার বিষয়ে জানতে চাইলে শুভাশীষ বলেন, ‘একই ধরনের কাপড় পরার কারণ হলো, এটা একটু ব্যতিক্রম বিষয়। মানুষ এত কিছু মনে রাখতে পারে না। উচ্চতায় বড় ও ছোট দুজন মানুষ কিছু একটা করছে। এটা মনে রাখার মতো। আমাদের পেজের নামটাও মনে রাখার মতো। একই কাপড় পরা হলো এত কিছুর ভিড়েও মনে রাখার মতোই এটা ব্যতিক্রম কিছু। আমরা সম্পর্কে বাবা ও ছেলে, দুই জনের উচ্চাতায় ছোট বড় পার্থক্য রয়েছে, আমরা একই পোশাক পরছি। এগুলো মানুষের রাখার মতো একটা বিষয় হিসেবেই ব্যবহার করছি।’
এমআইএস/এলএ/জেআইএম