দেশজুড়ে

রক্তাক্ত শৈলকুপায় এক মাসের ব্যবধানে ৭ খুন

এক সময় চরমপন্থী অধ্যুষিত জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল ঝিনাইদহ। প্রতিনিয়তই ঘটতো হত্যা, সংঘর্ষ, লুটপাট, প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুরের ঘটনা। পরে ২০০৮ সালে ঝিনাইদহে যোগদান করেন পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর। তার হাত ধরেই সংঘাত কিছুটা কমে আসে। কিন্তু সদ্য শেষ হওয়া ৫ম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শৈলকুপা উপজেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ। এরইম্যধ্যে খুন হয়েছেন ৭ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক।

সরকার দলীয় নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ও এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া গ্রাম্য প্রভাবশালীদের মধ্যে এসব সংঘর্ষ হচ্ছে। ঝিনাইদহ, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অতিরিক্ত পুলিশ উপজেলায় মোতায়েন করা হলেও থামানো যায়নি সংঘাত।

সহিংসতায় উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে পাঁচজন নিহত হয়, যাদের ৪ জন নৌকা প্রতীকের সমর্থক এবং এক জন বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক। এরা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ, এমনকি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িতও ছিলেন না। তারপরও রাজনীতির নামে দখল আর আধিপত্যের ক্রোধে তাদের জীবন দিতে হলো।

আয়ের উৎস এই মানুষগুলোকে হারিয়ে তাদের পরিবারগুলো চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। ঘটনার পর এলাকার মানুষ বিশেষ করে পুরুষরা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে বাড়ি ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন।

সর্বশেষ শনিবার (২১ জানুয়ারি) দিবাগত রাতে সারুটিয়া ইউনিয়নের পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার কাইছার টিপুর সমর্থক সারুটিয়া গ্রামের মেহেদি হাসান স্বপন নামের এক যুবককে মোবাইলে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষ বর্তমান চেয়ারম্যান (নৌকা) মাহমুদুল হাসান মামুনের সমর্থকরা। পরে বাড়ির পাশের তালতলা ব্রিজের ধারে নিয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে ফেলে রেখে যায়।

সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এরপর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুরে রেফার্ড করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

যদিও চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান মামুন স্বপনকে নিজের কর্মী বলে দাবি করেন।

এর আগে ৮ জানুয়ারি শনিবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নের দলিলপুর মাঠে কল্লোল হোসেন (৩৫) নামের এক জনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীরা।

এছাড়া নির্বাচনী সহিংসতায় মারা যাওয়া অখিল সরকার ইটভাটায় কাজ করতেন। শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নের ভোটার নন তিনি। থাকতেন ওই এলাকার একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে শ্বশুরবাড়িতে। নিজবাড়ি ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। হারান আলীও থাকতেন কাঁচেরকোল বাজারের পাশে একই আশ্রয়ণ প্রকল্পে। পেশায় কৃষি শ্রমিক ছিলেন। তবে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থক ছিলেন। ৩১ ডিসেম্বর সারুটিয়া ইউনিয়নের কাতলাগাড়ি বাজারে নৌকা প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় অখিল সরকার ও হারান আলী গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই হারান আলী মারা যান। আর অখিল সরকার ৫ জানুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

এদিকে ভোটের চারদিন আগে ১ জানুয়ারি শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে ভাটবাড়িয়া নামক স্থানে জসিম উদ্দীন (৩৫) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পেশায় একজন পোশাক শ্রমিক ছিলেন তিনি। দির্ঘদিন ঢাকাতে একমাত্র শিশু সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছিলেন। তিনি স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। প্রতিপক্ষের লোকজন ভেবেছিলেন নির্বাচনে ভোট দিতে বাড়িতে এসেছে, তাই তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।

এদিকে ৮ জানুয়ারি সকালে একই ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় জখম আব্দুর রহিম নামে এক ব্যক্তি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২৩ ডিসেম্বর উপজেলার একই ইউনিয়নে কাতলাগাড়ী বাজারে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসান মামুনের সমর্থক আব্দুর রহিমকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার কাইছার টিপুর সমর্থকরা।

উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ৬ নম্বর সারুটিয়া ইউনিয়নে ৫ জানুয়ারি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান। নির্বাচনে তার সঙ্গে শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার কায়সার টিপুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান ও বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকারের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়।

কাতলাগাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা দীলিপ সরকার জানান, তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৯০ পরিবার বাস করে। এদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র। একদিন কাজ না করলে তাদের খাবার জোটে না। এদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। তবে ভোটের সময় সবাই আনন্দ করেন। প্রার্থীদের নির্বাচনী কার্যালয়ে ঘুরে বেড়ান। নির্বাচনী প্রচারণা দেখতে গিয়ে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পেরই দুইজন প্রাণ দিলেন।

নির্বাচনী সহিংসতায় মারা যাওয়া অখিল সরকারের স্ত্রী বাসন্তী সরকার জানান, হাসপাতালে বসে তিনি তার স্বামীকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। নিজে খাবার না খেয়ে স্বামীর ওষুধ কিনেছেন। তারপরও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি।

নির্বাচনী সহিংসতায় মারা যাওয়া হারান আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেগম জানান, তার স্বামীও কোনোদিন রাজনীতি করেননি। নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা দেখতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাকে প্রতিপক্ষের লোকজন কুপিয়ে হত্যা করেন।

বিষয়টি নিয়ে সাবেক কলেজ শিক্ষক ও মানবাধিকার কর্মী আমিনুর রহমান টুকু জানান, এই উপজেলাটির মানুষের মধ্যে সহনশীলতা কম, উগ্র মেজাজের। অতি সামান্য বিষয় নিয়ে বড় ঘটনার জন্ম দেয়। এছাড়া এই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ উচ্চ শিক্ষিত, তেমনি প্রশাসনের উচ্চপদে কর্মরতও রয়েছে। সরাসরি এসব কর্মকর্তাদের প্রভাব এলাকায় না থাকলেও তাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজন মনে করে আমি অন্যের উপর প্রভাব খাটালে তারা রক্ষা করবে। এটিও সংঘর্ষ সৃষ্টির পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এছাড়া এসবের জন্য রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যও অনেকাংশে দায়ী।

এই শিক্ষক আরো জানান, এমন পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী ও নেতাকর্মীদের সহনশীল হতে হবে। তেমনি সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূ্ল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সর্বোপরি পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে যেন এই মানুষগুলো সহিংসতা ছেড়ে সাম্যের দিকে এগিয়ে আসে।

শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার জাহাদ বাদশা জানান, উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে এমন সংঘাত চলে আসছে। কোনোভাবেই এটিকে দমন করা যাচ্ছে না। এখানে সামাজিক দলাদলির কারণে সংঘাতটা বেশি।

সরকার দলীয় এই রাজনীতিবিদ বলেন, যদিও রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। তবুও হয়তো কোথাও বা কারো সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। শৈলকুপা উপজেলায় বিদ্যমান যে সহিংসতা তা রোধ করতে হলে শুধু আওয়ামী লীগকে দিয়ে সম্ভব না, এক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে অর্থাৎ সকল দলকে একত্রে ভূমিকা নিতে হবে। তাহলেই হয়তো সুদিন ফিরে আসবে।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ জাগো নিউজকে জানান, উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে সামাজিক বিভিন্ন দল রয়েছে। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় মারামারি হয়। ছোট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষেরই শত শত মানুষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে, এখানকার কালচারটাই এমন।

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো জানান, হানাহানি বন্ধ করতে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিভিন্ন সময় দুই পক্ষকে ডেকে আমরা কথা বলেছি তাদের নিবৃত করার জন্য। তাদের বাড়িতে আমরা অভিযান চালিয়ে ঢাল-শর্কিসহ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছি। মামলা হচ্ছে, আসামিও গ্রেফতার হচ্ছে। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ তৎপরতা সেখানে রয়েছে।

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এফএ/জেআইএম