বগুড়া বিমানবন্দর চালুর সম্ভাবতা যাচাইয়ের শেষ হয়েছে প্রায় তিনমাস আগে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রতিনিধিদল সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। এটি চালুর পক্ষে তারা প্রতিবেদনও দিয়েছেন। এখন বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু এতোকিছুর পরও বগুড়া বিমানবন্দর চালুর ‘সবুজ সংকেত’ বন্দি হয়ে আছে লাল ফাইলে। সরকারের নির্দেশনা পেলেই বগুড়ার আকাশে ডানা মেলবে সম্ভাবনার পায়রা। বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা।
সূত্র জানায়, গত ১৪ নভেম্বর বগুড়া বিমানবন্দর পরিদর্শন করে বেবিচক প্রতিনিধিদল। বেবিচক সদর দফতরের প্রশাসন বিভাগের উপ-পরিচালক (সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) বেগম ইশরাত জাহান পান্না পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
ইশরাত জাহান পান্না জানান, তারা বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তবে বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে আছে তা তিনি জানেন না। অনুমতি মিললে এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বগুড়া বিমানবন্দর চালু করার ব্যাপারে সংসদে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন গাবতলী-শাজাহানপুরের সংসদ সদস্য রেজাউল করিম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এটির কাজের বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। বেবিচক প্রশাসন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি কাজের কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে তারা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি। এ কারণে শিগগির আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেবিচকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলবো। তখন জানা যাবে বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে।’
বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের জন্য রাখা নির্মাণসামগ্রী। ছবি-জাগো নিউজ
সরেজমিন বিমানবন্দর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখান দিনরাত কাজ করছেন শ্রমিকরা। রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। তবে এটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য কাজ কি না সে ব্যাপারে দায়িত্বরত কেউ জানাতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া বিমানবন্দরকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী করতে আরও ১০০ একর জমি প্রয়োজন হবে। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের কিছু জমি বেদখল হয়ে গেছে। সেগুলোতে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের আটটি বিমানবন্দরের বিমান চলাচল অব্যাহত আছে। এগুলো হলো-ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাজশাহী শাহ মাখদুম (রহ.) অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর, যশোর বিমানবন্দর, সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও বরিশাল বিমানবন্দর।
বগুড়া বিমানবন্দর চালু করা হলে এটি হবে দেশের নবম অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর। জানা গেছে, বগুড়া বিমানবন্দরকে শেখ রাসেলের নামে চালুর দাবি জানিয়েছিলেন বগুড়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান।
ভৌগোলিক ও বাণিজ্যিক অবস্থান বিবেচনায় বগুড়া বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৮৭ সালে। এরপর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে শর্ট টেকঅফ অ্যান্ড ল্যান্ডিংয়ের (স্টল) উড়োজাহাজ চলাচলের ২২ কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। এরপর বগুড়া শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পশ্চিমে বগুড়া-নওগাঁ সড়কের ধারে এরুলিয়া এলাকায় প্রায় ১১০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পের আওতায় ৬০০ ফুট প্রস্থের পাঁচ হাজার ফুট রানওয়ে, অফিস ভবন, টার্মিনাল ভবন, আবাসিক ভবন বিমানবন্দরে পৌঁছার রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ-পানি সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হয়।
কথা ছিল ২০০০ সালের মধ্যে প্রকল্প কাজ শেষ হয়ে বগুড়া বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের আওতায় উড়োজাহাজ উড্ডয়ন-অবতরণ করবে। সব কিছু ঠিক থাকার পর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে বিমানবন্দরটি বিমানবাহিনীর কাছে ন্যস্ত করে। বিমানবাহিনী সেখানে রাডার স্টেশন স্থাপন করে সামরিক বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করে। গেল প্রায় ২৬ বছর ধরে বগুড়া বিমানবন্দর এভাবেই চলছে। বগুড়া বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে বিমানবন্দরটি বিমানবাহিনীর কাছে ন্যস্ত করে। ছবি-জাগো নিউজ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বগুড়া বিমানবন্দরকে সিভিল এভিয়েশনের আওতায় নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিটি বাজেটে বগুড়া বিমানবন্দর চালুর বিষয়টি উত্থাপিতও হয়। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান বগুড়া সফরকালে জানান, বগুড়া বিমানবন্দরকে সিভিল অভিয়েশনের (বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) আওতায় নিয়ে দেশের রাজস্ব আদায়ে ফ্লাইট পরিচালনায় তাদের কোনো আপত্তি নেই। এরপর বগুড়া বিমানবন্দরের বর্তমান রানওয়ের উভয়দিকে দেড় হাজার ফুট করে তিন হাজার ফুট সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কারণ আগের রানওয়ে ছিল স্টল বিমান ওঠানামার। বর্তমানে অধিক যাত্রী বহনের উন্নতমানের উড়োজাহাজ উড্ডয়ন- অবতরণের জন্য অন্তত আট হাজার ফুট রানওয়ে দরকার।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বগুড়া বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ বিমানের পাশাপাশি বগুড়া-ঢাকা-বগুড়া আকাশপথে বাংলাদেশ বিমান ও বেসরকারি বিমান সংস্থার ফ্লাইট চলাচলের কথা রয়েছে।
জানা গেছে, করোনার আগে প্রতিবছর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কয়েক দফা সম্মেলনে বগুড়ার ডিসিরা বগুড়া বন্দরে যাত্রীবাহী ফ্লাইটের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন। বছরতিনেক আগে বগুড়া বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ওপর মহলে পাঠানো হয়। ভূমি অধিগ্রহণ শাখা জানিয়েছে, সরকারি আদেশ পাওয়ার সঙ্গেই ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে।
এদিকে বগুড়া-৭ আসনের সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু বগুড়া বিমানবন্দর চালু করতে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাবনা পাঠান। তারপর বগুড়া বিমানবন্দর চালুর লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে বেবিচক। তারা বগুড়া বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন।
জেলা প্রশাসন ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সূত্র জানায়, বগুড়া বিমানবন্দরের রানওয়েকে আট হাজার ফুটে উন্নীত করা হবে। এর সঙ্গে জ্বালানি রিজার্ভার, যাত্রীদের সুবিধা, মালামাল ব্যবস্থাপনাসহ অন্য সুবিধার জন্য অন্তত একশ একর ভূমি প্রয়োজন। বিদ্যমান রানওয়ের পশ্চিমে জমি কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সূত্র জানায়, ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া আছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো চিঠি আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ষাটের দশকে হেলিকপ্টারে আকাশপথে বগুড়ার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ছিল। বগুড়ার বনানীতে হ্যালিপ্যাডে হেলিকপ্টার উড্ডয়ন ও অবতরণ করতো। কপ্টার সার্ভিস ছিল লাভজনক। ৫০ বছরে বগুড়া আরও উন্নত হওয়ায় উড়োজাহাজ ওঠানামার সার্বিক অবস্থা বিরাজ করছে।
বগুড়া বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ছবি-জাগো নিউজ
বগুড়ায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য রয়েছে আধুনিক স্টেডিয়াম। কয়েকটি স্টারমানের হোটেল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারগুলো এখন বগুড়ায় হচ্ছে। দেশের প্রাচীন নগরী মহাস্থানগড়ে পর্যটক আগমনের সংখ্যা বেড়ে পর্যটকভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিগগির অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ শুরু হবে। আকাশপথে ঢাকা যেতে মুখিয়ে আছেন বগুড়ার লোকজন।
জানতে চাইলে বগুড়ার শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মাছুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-অর্থনীতি, কৃষিসহ সব দিক থেকে এগিয়ে বগুড়া। নতুন শিল্প উদ্যোক্তারাও এখানে শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলও হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালু করা জরুরি।’
তিনি বলেন, সড়কপথে ঢাকা থেকে বগুড়া আসতে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। পথের ভোগান্তির কারণে বগুড়ায় কোনো বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও রপ্তানিকারকরা আসতে চান না। বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা না এলে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন তেমন কাজে আসবে না। তাছাড়া অনেক মানুষ এখন বগুড়া থেকে সড়কপথে ঢাকায় যাতায়াত করতে চান না। তারা বিমানে চলতে চান।
বগুড়ায় হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ী ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশি ও পর্যটক বগুড়ায় আসেন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী মহাস্থানগড়সহ দর্শনীয় ও ধর্মীয় একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে বগুড়ায়।
চেম্বারের তথ্য অনুযায়ী, এ জেলায় সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ছোটবড় প্রায় ২০টি শিল্পকারখানা রয়েছে। এসব শিল্পকারখানার মধ্যে রয়েছে-ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস ও ওয়ান ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম কনজ্যুমার প্রোডাক্ট, মোটরসাইকেল সংযোজন প্রতিষ্ঠান উত্তরা মোটরস, এবিসি টাইলস, পেপার ও পার্টিকেল বোর্ডের কারখানা। এছাড়া বগুড়ায় চারতারকা মানের হোটেল রয়েছে দুটি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে বিমানসেবা চালুর মতো সব ধরনের অনুকূল পরিবেশ বগুড়ায় রয়েছে।
বগুড়া বিমানবন্দরে বাণিজ্যিক বিমানসেবা চালু হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্ভাবনার দুয়ার আরও বড় হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্প মালিক সমিতির জেলা সভাপতি আব্দুল মালেক।
তিনি বলেন, এখানে যোগাযোগ, পরিবেশ, পাইপলাইনে গ্যাসসহ নানা কারণে শিল্পের অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান আছে। শুধু বিমান যোগাযোগ সুবিধা না থাকায় বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বগুড়া বিমানবন্দর চালু হলে বদলে যেতে পারে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি। ব্যবসার গতি ফেরার পাশাপাশি এক সময়ের শিল্পনগরী খ্যাত বগুড়া দেশি-বিদেশি বিনোয়োগকারীদের জন্য অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি পৌঁছে যেতে পারে বিদেশি ক্রেতাদের হাতে। এখন সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় বগুড়াবাসী।
এসআর/এমএস