দেশজুড়ে

কালের সাক্ষী লেটারপ্রেস: অন্তহীন খাটুনিতে ছাপা হতো পত্রিকা

লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন। একজন লোক ছোট একটি টুলে বসতেন, তার সামনের টেবিলের ওপর, টেবিলের গা ঘেঁষে সামনে, ডানপাশে, বামপাশে ছোট ছোট অনেক খোপের কাঠের পাত্র থাকতো। সেসব খোপে সিসা দিয়ে বানানো উল্টো করে তৈরি বাংলা বা ইংরেজি বর্ণ থাকতো। একেকটি খোপে একেক ধরনের বর্ণ থাকতো। টুলে বসা সেই লোকটি খোপ থেকে একটি একটি করে বর্ণ তুলে নিতেন। তারপর একটির পর একটি বর্ণ বসিয়ে শব্দ তৈরি করতেন। যেমন- বই লিখতে হলে ‘ব’বর্ণের খোপ থেকে ‘ব’ এবং ‘ই’ বর্ণের খোপ থেকে ‘ই’ নিয়ে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি হতো ‘বই’ শব্দটি।

এভাবে অনেক শব্দ বসিয়ে একটি বাক্য তৈরি হতো। অনেক বাক্য দিয়ে একটি লেখা তৈরি করে ‘গ্যালি’ নামের একটি কাঠের পাত্রে বর্ণগুলো রাখা হতো। গ্যালিতে রাখা সেসব উল্টো বর্ণের গায়ে রোলার দিয়ে কালি লাগানো হতো। তারপর কালিমাখা সেসব বর্ণের ওপর বিশেষ একটি পদ্ধতিতে নিউজ প্রিন্টের একটি কাগজ চাপ দেওয়া হতো। তখন সেই নিউজ প্রিন্টের কাগজে বর্ণগুলো ফুটে উঠতো। তারপর দেখা হতো বানান ঠিক হয়েছে কি না।

ছাপা কাজে ভুল হলে ভুল বর্ণ সরিয়ে সঠিক বর্ণ বসানো হতো। প্রুফ দেখার পর গ্যালিতে সাজানো বর্ণ মেশিনে সেট করে কাগজে ছাপানো হতো। বর্ণ বা লেটার বসিয়ে ছাপার কাজ হতো। এভাবেই কাজ হতো লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে।

প্রথম দিকে সেসব মুদ্রণযন্ত্র বিদ্যুৎ ছাড়া পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে চালানো হতো। তখন মেশিনের ভেতর হাত দিয়ে একটি কাগজ ঢোকানো হতো, মেশিনে চাপ খেয়ে কাগজটিতে লেখা ফুটে ওঠার পর সেই কাগজ বের করা হতো। তারপর আরেকটি কাগজ বসানো হতো, তারপর আরেকটি। এভাবে চলতো ছাপার কাজ। এরপর সেসব মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘরের ফলক/ছবি: জাগো নিউজ

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলায় সর্বপ্রথম ট্রেডল মেশিন বা লেটারপ্রেসের প্রবর্তন করেন উপমহাদেশের সংবাদপত্রের পথিকৃৎ হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ। কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরবর্তী কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়ায় অভাব-অনটন সত্ত্বেও অবহেলিত সমাজের বৈষম্য এবং জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করতে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কাঙাল হরিনাথ প্রথম মাসিক সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। প্রথম দিকে হাতে লিখে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। পরে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের যন্ত্রে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা। শেষ দিকে এক পয়সার সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয় এটি।

নিঃস্ব কাঙাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ না দেখলেও ১৮৭৩ সালে নিজ গ্রাম কুন্ডুপাড়ায় ’গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে লেটারপ্রেস কিনে আনেন। দীর্ঘ ১৮ বছর রাজশাহীর রানি স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থ আনুকূল্যে পত্রিকা চালানোর পর আর্থিক অনটন ও সরকারের মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার কারণে পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

কাঙাল হরিনাথ মজুমদার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু কুমারখালী শহরের কুন্ডুপাড়ায় তার ঐতিহাসিক সেই ছাপার যন্ত্র, এম এন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পাণ্ডুলিপি আজও কালের স্মৃতি হয়ে আছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বোমা হামলায় কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা ঘরের ছাদ ধ্বংস হয়ে গেলেও ছাপাখানাটি কোনো রকমে রক্ষা পায়। বাড়ির এক কোণে আজও পড়ে আছে সেই প্রেসটি, যাতে রয়েছে কাঙাল হরিনাথ, লালন শাহ, মীর মশাররফ হোসেন ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ। ‘বাংলা মুদ্রণ যন্ত্র’ নামের যে যন্ত্রটিতে তিনি ১৮৭৩ সালে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ছাপিয়ে ছিলেন, সেটি দর্শনার্থীদের জন্য এখনও তার বাড়িতে রাখা আছে।

বাণিজ্যিকভাবে কুষ্টিয়া জেলায় ব্রিটিশ শাসনামলে দেবন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামের ব্যক্তি কুষ্টিয়া শহরে প্রথম লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন স্থাপন করেন। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পাকিস্তান আমলে কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়ায় আব্দুল বারী সুলভ প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ধীরে ধীরে দেওয়ান প্রেস, ন্যাশনাল প্রেস, মুকুল মুদ্রণ, কল্লোল মুদ্রায়ণ, রহমান প্রেস, জিনাত প্রেস, ওয়েসিস প্রিন্টিং প্রেস, টাউন প্রেস, লিয়াকত প্রেস, পপুলার প্রিন্টিং প্রেস, চৌধুরী প্রেস, জাগরণী মুদ্রায়ন, বলাকা প্রেসসহ ২০-২৫টি লেটারপ্রেস গড়ে ওঠে। এসব প্রেস থেকে মূলত বই, পুস্তক, লিফলেট, লেভেল, ক্যাশ মেমো, বিয়ের কার্ড ছাপা হতো। পুরোনো এসব প্রেসের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যারা এই ব্যবসায় টিকে আছেন, নব্বই দশকের পর তারা লেটারপ্রেস ছেড়ে আধুনিক অফসেট প্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।

কালের সাক্ষী হয়ে আছে কুষ্টিয়ার লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন/ছবি: জাগো নিউজ

কাঙাল হরিনাথের প্রেসটি ছাড়া কুষ্টিয়া জেলায় এখন একটি মাত্র লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শহরের কোর্টপাড়া এলাকায় কল্লোল মুদ্রায়ন নামের প্রেসে আছে এই লেটারপ্রেস। প্রেসটির বর্তমান স্বত্বাধিকারী মিঠু সাহা জানান, তার বাবা কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মলিন কুমার সাহা প্রেস ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে তিনি চীনের তৈরি লেটার মেশিন দিয়ে প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। নব্বই দশক পর্যন্ত মেশিনটি সচল ছিল। পরে ব্যবসার প্রয়োজনে আধুনিক অফসেট মেশিন আনা হয়। লেটারপ্রেস যুগের অবসান হয়। গত বছর মলিন কুমার সাহা মারা যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লেটারপ্রেসটি স্মৃতি হিসেবে প্রেসের এক কোণে সংরক্ষণ করেছেন।

মিঠু সাহা আরও জানান, পিতার শেষ স্মৃতি হিসেবে তারা আজও প্রেসটি রেখে দিয়েছেন।

প্রবীণ সাংবাদিক কুষ্টিয়ার সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ বার্তার সম্পাদক ও অধুনালুপ্ত জাগরণী প্রেসের স্বত্বাধিকারী আবদুর রশীদ চৌধুরী জানান, কুষ্টিয়া থেকে প্রায় ৫৬ বছর আগে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক জাগরণী পত্রিকা প্রকাশিত হতো। যার প্রকাশনা এখনো অব্যাহত আছে। এরপর তার সম্পাদনায় ইংরেজি উইকলি রিভিউ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যার প্রকাশনার বয়স প্রায় ৪৫ বছর। পরে একই প্রেস থেকে তার ভাই প্রয়াত ওয়ালিউল বারী চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ইস্পাত পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে এই লেটারপ্রেসেই আবদুর রশীদ চৌধুরীর সম্পাদনায় কুষ্টিয়ার প্রথম দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ বার্তা প্রকাশিত হয়।

আবদুর রশীদ চৌধুরী আরও জানান, সে সময় লেটারপ্রেসে পত্রিকা বের করা ছিল ভীষণ খাটুনির কাজ। একটা একটা করে অক্ষর টাইপ করে শব্দ তৈরি করতে হতো। এখনকার মতো ছবি ছাপা যেত না। আগে থেকে কাঠের মধ্যে ব্লক তৈরি করে তারপর ছবি ছাপতে হতো।

কালের সাক্ষী হয়ে আছে কুষ্টিয়ার লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিন/ছবি: জাগো নিউজ

কথা হয় লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে কাজ করা বিদেশ বাবুর সঙ্গে। তিনি এখন কল্লোল মুদ্রায়ন প্রেসে কর্মরত। বিদেশ বাবু জানান, তখন তাদের প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক মজুরি দেওয়া হতো। সাপ্তাহিক মজুরি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কে কতটা টাইপ করেছেন সেই হিসাবে তাদের মজুরি দেওয়া হতো। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনে কাজ করা শ্রমিক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অধিকাংশ শ্রমিকই মারা গেছেন। দু-একজন যারা আছেন তারাও পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

কুষ্টিয়া শহরের পদ্মা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক শহিদুল ইসলাম জানান, লেটারপ্রেসের সিসার তৈরি বর্ণগুলো আসতো কলকাতা থেকে। সে সময় দুভাবেই লেটার মেশিন চালানো যেত। একটা পা দিয়ে। সেজন্য এটাকে ট্রেডল মেশিন বলা হতো। আবার বিদ্যুতের সাহায্যেও প্রেস চালানো যেত। ১৯৯০ এর দশকের পর মুদ্রণশিল্পে আধুনিক অফসেট প্রেসের আবির্ভাব ঘটার পর এই লেটারপ্রেস বা ট্রেডল মেশিনের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। সেই সময়ের ট্রেডল মেশিনের মালিকরা তাদের ব্যবহৃত মেশিনগুলো লোহার দামে ভাঙাড়ি হিসেবে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলায় কাঙাল হরিনাথের এম এন প্রেসের একটি এবং কল্লোল মুদ্রায়ন প্রেসে সংরক্ষিত লেটারপ্রেসটিই কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

আল-মামুন সাগর/এইচএ/এমএস