দেশজুড়ে

কুয়াকাটায় জেলিফিশের মৃত্যু নিয়ে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে

গত বছর পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে উদ্বেগজনকহারে ডলফিনের মরদেহ ভেসে এসেছিল। এবার সেখানে প্রতিদিন ভেসে আসছে হাজার হাজার জেলিফিস। সমুদ্রের আভ্যন্তরীণ কোনো সমস্যা রয়েছে কী-না তা অনুসন্ধানে সরকারকে এখনি মনযোগী হতে হবে।

মঙ্গলবার (৮ মার্চ) সন্ধ্যায় কুয়াকাটা পৌরসভার হলরুমে সমুদ্র বিষয়ক পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ আওয়ার সি আয়োজিত ‘সমুদ্র সুরক্ষা ও সুনীল অর্থনীতি’- শীর্ষক এক কোস্টাল সিম্পোজিয়ামে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সেভ আওয়ার সি-এর রিসার্চ ফেলো ও প্রাণ-প্রকৃতি সাংবাদিক কেফায়েত শাকিলের সঞ্চালনায় এবং সংগঠনের মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হকের সভাপতিত্বে সিম্পোজিয়ামে প্রধান অতিথি ছিলেন কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। আরও বক্তব্য রাখেন ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা জোনের পরিদর্শক বদরুল কবীর, মহিপুর প্রেস ক্লাব সভাপতি মনির হোসেন, কুয়াকাটা প্রেস ক্লাব সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব, পর্যটন ও পরিবেশকর্মী কে এম বাচ্চু প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘কুয়াকাটায় আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে ট্যুরিস্ট আরও বেশি আসবে। এসব মাথায় রেখেই আমরা শহরের উন্নয়ন করছি। আমরা চাচ্ছি এখানে টেকসই পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে; কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল সৈকতের কোনো নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। আমি চাইলেও ওখানকার কিছু পরিবর্তন করতে পারবো না। সৈকত থেকে টঙ দোকান সরিয়ে দিলে সেসব দোকানদারদের পরিবার কীভাবে চলবে। এসব ভেবে আমরা চেষ্টা করছি পৌরসভায় একটি মার্কেট করতে। বিচে বাইক চলার অন্যতম কারণ রাস্তা না থাকা।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী কুয়াকাটাকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহকে মূল্যায়ন করতে আমরা এ শহরকে টেকসই ও সুন্দর একটি শহরে রূপ দেওয়ার কাজ করছি। কিন্তু আমাদের এখানে হাই-প্রোফাইল ট্যুরিস্ট আসেন না বিমানবন্দর না থাকায়। যার কারণে এখনো কুয়াকাটা সেভাবে সেজে উঠেনি। আমি অনুরোধ করবো এবং আহ্বান জানাবো অতিদ্রুত এখানে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হোক।

সভাপতির বক্তব্যে সেভ আওয়ার সি-এর মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, কুয়াকাটা সৈকতের জীব বৈচিত্র্য রক্ষা না করলে এখানকার পর্যটন ও মৎস্য সম্পদ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সৈকতের লাল কাঁকড়ার কারণে এখানে আসতে উৎসাহিত হন পর্যটকরা। এরা মারা গেলে পর্যটক এসে কী দেখবেন? একইভাবে সমুদ্র মাছ উৎপাদন হলে সেটি ধরে জীবিকা নির্বাহ করবেন জেলেরা; কিন্তু সমুদ্র দূষণ ও অনিয়ন্ত্রিত আহরণের কারণে মৎস্য সম্পদ কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা।

গবেষণা বলছে, প্রতিদিন বিচ বাইকের চাপায় অন্তত ছয় হাজার কাঁকড়ার মৃত্যু হয়। জেলেরাও অপ্রয়োজনীয় অনেক পোনামাছ ও সামুদ্রিক প্রাণী ধরে এনে নষ্ট করছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত হুমকিতে পড়ছে আমাদের সমুদ্রের জীব বৈচিত্র্য।

তিনি বলেন, সৈকতে সম্প্রতি একের পর এক জেলিফিস মরে ভেসে আসছে। আমরা জানি মাঝে মাঝে জেলিফিস ডাঙায় এসে আটকা পড়ে মারা যায়। কিন্তু এতো বেশি সংখ্যক হারে মৃত্যু আগে দেখিনি। আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি সৈকতে আসার আগেই এগুলো মরে যাচ্ছে। কয়েকদিন ধরেই আমরা দাবি করছি, এ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। জলবায়ুর ভারসাম্য থাকলে মরলেও এরা সৈকতে আসতো না। সৈকতে এত সংখ্যায় আসা বলে দিচ্ছে এখানকার পরিবেশ ভেঙে পড়েছে। সরকারের উচিত জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে সমুদ্রের কোনো মড়ক পড়েছে কিনা সেটা নিয়ে গবেষণা করা।

একইসঙ্গে কুয়াকাটায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়া, বিচে যানবাহন নিষিদ্ধকরণ, চরগুলোতে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ও ম্যানগ্রোভ বনায়নের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন সেভ আওয়ার সি এর মহাসচিব।

ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য কে এম বাচ্চু বলেন, এ সৈকতে গত বছরে আমরা দেখেছি একে একে ২২টি ডলফিনের মৃতদেহ উঠে এসেছিল। যার অধিকাংশ জেলেদের জালে আটকে মারা গেছে বলে প্রমাণ মিলেছে; কিন্তু এসব প্রতিকারের কিংবা দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে প্রতিদিন হাজার হাজার জেলিফিসের মৃতদেহ ভেসে আসতে শুরু করেছে। আগেও আসতো; কিন্তু এখন যে হারে আসছে তাকে স্বাভাবিক বলার কোনো সুযোগ নেই। দ্রুত এই ঘটনার কারণ খুঁজতে সরকারকে তৎপর হতে হবে।

তিনি অভিযোগ করেন, সৈকতে প্রতিদিন শত শত মোটরসাইকেল চলে। মোটরসাইকেল চাপায় হাজারে কাঁকড়া মারা যায়। সৈকত প্লাস্টিক আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সেগুলো ঢেউয়ের সঙ্গে সমুদ্রে যায়। এখানে নিষিদ্ধ মাছ ধরা হয়, বন্যপ্রাণী হত্যা করা হয়; কিন্তু দেখার কেউ নেই।

কুয়াকাটা প্রেস ক্লাবের সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, কুয়াকাটা দিন দিন অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। এখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিচ বাইকের দৌরাত্ম্য বিন্দুমাত্রও কমেনি বরং বাড়ছে। উল্টো পুলিশের বাইকও সৈকতে পর্যটক বহন করে। চর বিজয়ে যাও কিছু পরিবেশ ছিল সেটাও এখন ধ্বংসের পথে।

মহিপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানান কারণে আমরা কুয়াকাটার মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের সৈকতে ভাঙন সুস্পষ্ট। সৈকতের পাসের বনের গাছ মারা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের কারণেও বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বনের জমি দখল হচ্ছে, উজাড় হচ্ছে। সৈকতে চলা বাইকের কারণে বন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমুদ্রের অনেকগুলো প্রাণীও মারা পড়ছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা জোনের পরিদর্শক বদরুল কবীর বলেন, পর্যটন ও জেলেসহ সমুদ্র সম্পৃক্তদের সচেতন করতে এ আয়োজন অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রাণ-প্রকৃতির বিষয়ে মানুষ সচেতন থাকলে পুলিশ লাগে না। সমুদ্র প্রতিবেশ রক্ষায় পর্যটকদের বাধ্য করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ শক্ত অবস্থানে থাকবে।

আরএইচ/জিকেএস