মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইরাক। সেখানকার মুসলিমরা কীভাবে রমজান পালন করেন, তা নিয়ে লিখেছেন মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রস্তুতি শুরু মাসখানেক আগ থেকেমুসলিম অধ্যুষিত ইরাকের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা গেলেও তারা তাদের ইসলামি ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন বেশ ভালোমতোই। ইরাকে রোজার প্রস্তুতি শুরু হয় মাসখানেক আগ থেকেই। নানা রকম রান্নার জোগাড়যন্ত্রে ভরতে থাকে ইরাকিদের ভাঁড়ার। এ ভাঁড়ারকে স্থানীয় ভাষায় ‘মুনেহ’ বলা হয়। মুনেহতে সাধারণত অপচনশীল শুকনো খাবার-দাবার সংরক্ষণ করা হয়।
রমজানের চাঁদকে অভিনন্দন ও বিদায়ইরাকের মুসলমানরা উসমানীয় শাসনামল থেকেই রমজান মাসকে নিয়মিত উদযাপন করে আসছে। রমজানের আগ থেকেই তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রমজান মাসকে স্বাগত জানায় আপন ঐতিহ্যে। রমজানের চাঁদকে যেমন তারা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানায়, ঠিক তেমনি বিদায় জানায় রমজান মাসকেও।
তোপধ্বনি দিয়ে রমজান বরণইরাকে রমজান মাসকে স্বাগত জানানো হয় তোপধ্বনির মাধ্যমে। এ সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করেছে তুর্কিদের কাছ থেকে। তুর্কির উসমানীয় শাসনামলে বাগদাদবাসীকে তোপধ্বনির মাধ্যমে ইফতার ও সেহরির সময় সম্পর্কে অবগত করানো হতো। তোপধ্বনির মাধ্যমে সময় জানানোর এ পদ্ধতি ইরাকিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখনও তা ইরাকে টিকে আছে একটি জনপ্রিয় রমজান সংস্কৃতি হিসেবে।
কম্পিউটারাইজড দূর-নিয়ন্ত্রিত তোপইরাকবাসী ইফতারের জন্য তোপধ্বনির অপেক্ষা করে। শিশুরা আকাশে আগুনের ফুলকি দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির ছাদে কিংবা খোলা মাঠে। তবে হ্যাঁ, এখন আর উসমানি আমলের তোপগুলো ব্যবহার করা হয় না। বর্তমানে কম্পিউটারাইজড দূর-নিয়ন্ত্রিত তোপ ব্যবহার করা হয়।
রমজানের ভিন্ন রকম ঐতিহ্যরমজানে ইরাকের ঐতিহ্য হলো, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। এ সময় তারা পরস্পরকে ধর্মীয় গ্রন্থাদি উপহার দেয়। পরিবার-প্রধান শিশু সদস্যদের কোরআন শরিফ উপহার দেয়। ইরাকিরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে বিয়েগুলো রমজান মাসে সম্পন্ন করতে।
পুরোনো ঐতিহ্যকেই অনুসরণঅন্যান্য দিক থেকে আধুনিকতার ছোঁয়া পেলেও ইরাকিরা ইফতারের ব্যাপারে এখনও পুরোনো ঐতিহ্যকেই অনুসরণ করে থাকেন। ইরাকি ইফতারের মধ্যে থাকে প্রথমত তাজা অথবা শুকনো খেজুর এবং শিনেনা বা টক দই দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক রকম শরবত। এর সঙ্গে থাকে মসুর ডালের স্যুপ। থাকে সিদ্ধ চালের ভাত এবং ভেড়া অথবা মুরগির মাংস। সেই সঙ্গে থাকে শরবত। মিষ্টান্ন হিসেবে থাকে মাহাল্লাবি বা দুধের তৈরি পুডিং।
খোলা প্রাঙ্গণে বসে ইফতারপবিত্র রমজান মাসে প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে ইফতার সামগ্রী পাঠানো ইরাকিদের আরেক ঐতিহ্য। এ প্রচলন এত বেশি যে, এর ফলে অনেক সময় নিজেদের ঘরে তৈরি খাবারও নিজেরা খাওয়ার সুযোগ পায় না। ইরাকিরা খোলা ছাদে বা বাড়ির সামনে খোলা প্রাঙ্গণে বসে ইফতার করতে পছন্দ করে। এটা ইরাকের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি। যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে খোলা ছাদে বা প্রাঙ্গণে ইফতার করা সম্ভব নয়।
ইফতারে বিশেষ পছন্দরমজানে ইরাকিরা বিশেষ খাবারের আয়োজন করে থাকে। যা অন্য কোনো মাসে পাওয়া যায় না। ইফতারে ইরাকিদের প্রধান পছন্দ বসরার খেজুর ও দুধ এবং বিশেষ ধরনের শরবত। যা তারা ইফতার-সেহরি উভয় সময় পরিবেশন করে। তা ছাড়া পারিবারিকভাবে সবাই মিলে ইফতার করতে পছন্দ করে।
রমজানের বিশেষ খাবারযুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে রমজানে আগের জৌলুস নেই। তারপরও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ইরাকিরা তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। খাবার-দাবারের জন্য দুনিয়াজুড়ে সুনামের অধিকারী এ দেশটিতে রমজানের খাবারে থাকে বৈচিত্র্য। সেহরির সময় অল্প আহার করলেও ইফতারে থাকে নানা আয়োজন।
সেহরি ও ইফতারিসেহরির সময় খুবই অল্প আহার করেন তারা। এ সময় সাধারণত তারা মাখন দিয়ে রুটি আর শসা খেয়ে থাকেন। সঙ্গে থাকে নানা পদের শরবত। প্রচুর পানি পান করেন তারা। বেশির ভাগ ইরাকি গরু, মহিষ কিংবা ছাগলের দুধ পান করে রোজা ভাঙে। এরপর তারা বসরার খেজুর খান। সঙ্গে বিশেষ ধরনের শরবত। যা তারা ইফতার-সেহরি উভয় সময়ই পান করেন।
ইফতারের টেবিলে জনপ্রিয়ইফতারে বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় মিষ্টি, বিরিয়ানি, কাবাব। ময়দা, চাল এবং আলু দিয়ে তৈরি কুব্বা বুরগাল, কুব্বা হালেব ও পটেটো চপের পাশাপাশি মিষ্টি ও নুডলস দিয়ে বানানো সুস্বাদু খাবার ‘হালাওয়াত শারিয়াহ’ ইফতারের টেবিলে খুবই জনপ্রিয়। ইরাকের বাইরে এ খাবার ‘সুইট অ্যান্ড গোল্ডেন ভার্মিসেলি নুডলস’ নামে পরিচিত।
ইফতারে শেখ মাহসি ও দোলমাএ ছাড়া দৈনন্দিন খাবার ‘শেখ মাহসি’ এবং ‘দোলমা’ও থাকে ইফতারে। সবজি দিয়ে কয়েক পদের দোলমা বানানো হয়। আর শেখ মাহসি তৈরি হয় মাংস ও বেগুন দিয়ে। এ ছাড়া ইফতারে থাকে গরু, মহিষ কিংবা ভেড়ার কাবাব, বিরিয়ানি, নাওয়াশিফ এবং থারিড। শেষের দুই পদ মুরগির মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়।
উৎসবে আপ্যায়নের টেবিলে ক্লেইচারমজানের শেষ ১০ দিন অবশ্য ইরাকিদের ঘর থাকে তাদের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ‘ক্লেইচা’ দিয়ে। কেবল রমজানের সময় নয়, যে কোনো উৎসবে বিস্কুট জাতীয় এ খাবারের কদর অনেক। খেজুর, বাদাম, চিনি ও শুকনো নারকেলে ভরা ইরাকের জাতীয় বিস্কুট হিসেবে পরিচিত এই ক্লেইচা খুবই সুস্বাদু। তাই ইরাকিদের সব উৎসবে আপ্যায়নের টেবিলে নানা আকৃতির ক্লেইচা দেখা যায়। স্বাদের পাশাপাশি এর গন্ধও মনমাতানো। ক্লেইচা সাধারণত এলাচের ফ্লেভারের হয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে গোলাপের ফ্লেভার দিয়েও তৈরি হয়। স্যাফ্রন রং দেওয়া এই বিস্কুট সাধারণত চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
নানা স্বাদের খাবারের বেচাকেনাপুরো রমজানজুড়ে বাগদাদের শোরজাহ বাজারে চলে নানা স্বাদের খাবারের বিকিকিনি। আগের মতো প্রাণচাঞ্চল্য না থাকলেও সহিংসতা, আতঙ্ক কাটিয়ে ভিড় জমে সাতশ’ বছরের ঐতিহাসিক মার্কেটটিতে।
মসজিদে সাজ সাজ রববিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের ন্যায় রমজানে ইরাকের মসজিদগুলোও জেগে ওঠে। মুসল্লিতে মুখর হয়। সব বয়সী মুসল্লিই উপস্থিত হয় মসজিদে। ইরাকের পুরুষরা মসজিদে দীর্ঘ সময় কোরআন তেলাওয়াত ও নফল ইবাদত করে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইবাদত-বন্দেগি করতে উৎসাহিত করে। তাদের সঙ্গে করে মসজিদে নিয়ে আসে। মসজিদের পরিচালকরা রমজানের আগ থেকে মসজিদের সাজসজ্জা ও বিশেষ পরিচর্যায় মনোযোগী হয়। বিশেষত শীত ও গরমের চাহিদা অনুযায়ী এসি ও হিটারের ব্যবস্থা করা হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার আয়োজনসাধারণভাবে প্রতিটি মসজিদেই উন্মুক্ত ইফতারের আয়োজন করা হয়। রমজানে সেখানে মসজিদে মসজিদে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ীদেরকে সামাজিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
ইতিহাসবিজড়িত মেহবিসরমজান মাসকে উদযাপনের সবচেয়ে ভিন্নধর্মী ও আনন্দমুখর রীতি সম্ভবত ইরাকেই দেখা যায়। রমজানের রাতের প্রথম প্রহরে ইফতারের পর সমগ্র ইরাকে ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাই একটি ঐতিহ্যবাহী খেলার জন্য একত্রিত হয়। এর নাম মিহবেস। এটি প্রধানত পুরুষদের খেলা। এই খেলায় অংশ নেন প্রায় ৪০ থেকে ২৫০ জন খেলোয়াড়ের দুটি দল। সকলেই পালাক্রমে মিহবেস বা আংটি লুকায়। খেলাটি শুরু হয় দলনেতার কাছ থেকে। তার হাতে ধরা থাকে আংটিটি, হাত জড়ানো থাকে কম্বলে। তিনি অন্যদের হাতে মিসবেহ বা আংটি দেওয়ার ভান করেন। অন্য সদস্যরা তার হাত কোলের ওপর শক্ত মুঠি ধরে বসে থাকে। নেতা গোপনে অন্য কোন খেলোয়াড়ের কাছে আংটি দিয়ে গেছেন, তা খুঁজে বের করতে হয় অপর দলের খেলোয়াড়দের।
মিহবেসে বাড়ে সংঘবদ্ধতাযদিও খেলাটির উৎস অজানা, তবে এর সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারীদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা বাড়ে। কয়েক দশক আগে ইরাকি সরকার এ খেলাটি আয়োজন করেছিল। এর ফলে শত শত অংশগ্রহণকারী একত্রিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে হৃদ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যদিও এই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে মিহবেস খেলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার ফিরে এসেছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ে এ খেলাটি আবারও খেলা হচ্ছে।
মুনশি/এসইউ/এমএস