জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সবচেয়ে বেশি যে নদীটির নাম এসেছে, সেটা হচ্ছে ধানসিড়ি। জন্মান্তরে কবি এ নদীতীরে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছেন। কবির স্মৃতিবিজড়িত ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী সেই ধানসিড়ি নদী পুনঃখননে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খনন যন্ত্র দিয়ে নদীর দু’পাড় থেকে মাটি কেটে পাড়েই এমনভাবে রাখছে, বৃষ্টি হলেই মাটি ধুয়ে আবার নদী ভরাট হয়ে যাবে। এছাড়া এখনই খননকৃত নদীর পাড় ভেঙে পড়ছে। আবার নদীর মাঝে জায়গায় জায়গায় বাঁধ রাখা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ধানসিড়ি খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে চিরতরে নদীটি বিলীনের মুখে ফেলছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। ৭ এপ্রিল সকাল ১০টায় রাজাপুর বাগড়ি এলাকায় ধানসিড়ি রক্ষার দাবিতে মঠবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মানববন্ধন ও বিক্ষোভও করেন এলাকাবাসী। বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের উপজেলার বাগড়ি বাজার স্কুল এলাকায় এ মানববন্ধন করা হয়। স্থানীয়দের আয়োজিত এ মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে বাগড়ি বাজার এলাকায় সংক্ষিপ্ত বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে খনন না হওয়ায় দখল আর পলিতে নদীটি ভরাট হয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে খনন কাজ শুরু করা হলেও তা সরুভাবে খনন করে একদম খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদীটি সঠিকভাবে খনন করে আগের মতো নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।
ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, প্রধানমন্ত্রীর ডেলটা প্ল্যান অনুযায়ী ৬৪ জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট নদী ও খাল খনন প্রকল্পের আওতায় ধানসিড়ি নদীটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ বছর মেয়াদে দুই কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটি ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে খনন কাজ শুরু করা হয়। রাজাপুর উপজেলার বাগড়ি বাজারের জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটির ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮০৬.৫ ঘনমিটার মাটি খনন করা হবে।
এ কাজের জন্য মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। ওই বছরের ১২ মার্চ কাজ শুরু এবং ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল সম্পন্ন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কাজ সম্পন্ন না করেই বিল বকেয়া রেখে ফেলে চলে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সরেজমিন ধানসিড়ি নদী খনন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাগড়ি বাজার ব্র্যাক এলাকা থেকে ১টি খনন যন্ত্র দিয়ে খনন কাজ করছে। তবে খনন কাজ তদারকির জন্য কাউকে দেখা যায়নি।
স্থানীয় একাধিক কৃষক ও এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, ধানসিড়ি নদী খননে শুরু থেকেই দু’পাড় থেকে খনন যন্ত্র দিয়ে মাটি ছেঁটে ও চাপিয়ে পাশে রেখে নদী তীরের উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে। প্রকল্পের শর্তানুযায়ী নদীর উপরের চওড়া বা প্রস্থ ৭০ ফুট করার নিয়ম থাকলেও করা হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ ফুট। তীর বা সমতল থেকে সাড়ে ১৫ ফুট গভীর করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে করা হচ্ছে সাড়ে ১০ ফুট। তলদেশের ২০ ফুট প্রস্থও সঠিকভাবে হচ্ছে না। পাড় থেকে দূরে মাটি রাখার নিয়ম থাকলে মাটি উঠিয়ে খনন কাজের পাশে রাখার কারণে বৃষ্টিতে তা ধুয়ে পুনরায় নদীটি ভরাট হয়ে যাবে।
তৃতীয়বারে এ খনন কাজ চলায় গত ২ বারের খননের পরে খালের তলদেশ উপরের পাশের মাটি ধুয়ে অনেকটাই ভরে গেছে। এ ছাড়া নদীর মাঝে মাঝে বাঁধ রাখা হচ্ছে। এতে কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় খননকৃত নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া না গেলেও ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, ডিজাইন ও প্ল্যান অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি চলছে। তৃতীয়বারের খননকাজে নদীটির পূর্বে স্বাভাবিক মাপ অনুযায়ী উপরের প্রস্থ ঠিক রেখে গভীর করার বিষয়টিই মুখ্য। তলদেশে গভীরতার কাজ এখনও শুরু হয়নি। শুধুমাত্র পাশের মাপ অনুযায়ী মাটি কেটে তীরে রাখছে। পরে ওই মাটি দিয়েই বেড়িবাঁধ দিয়ে বাকি মাটি অপসারণ করা হবে।
তিনি বলেন, ধানসিড়ি নদী খননে কোনো অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না এবং খননের সব শর্তের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। খনন কাজ সঠিকভাবে তদারকি করা হচ্ছে। খননের পর মেপে যেটুকু মাটি কাটা হয়েছে, সে অনুযায়ী বিল দেওয়া হবে। কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করার সুযোগ নেই।
এফএ/এমএস