বিশেষ প্রতিবেদন

আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি নেই সিরামিক কোম্পানির শেয়ার দামের

বর্তমানে শেয়ারবাজারে আলোচিত কোম্পানি শাইনপুকুর সিরামিক। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। গত ১৮ এপ্রিল সিরামিক খাতের এই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ২৫ টাকা। সেখান থেকে টানা বেড়ে ১৬ মে প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪৬ টাকা ৯০ পয়সায় ওঠে। শেয়ারের এমন দাম বাড়লেও কোম্পানিটির আর্থিক চিত্র খুব একটা ভালো নয়। চলমান হিসাব বছরের নয় মাসের (২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত) ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে মাত্র ২৭ পয়সা।

Advertisement

আগের হিসাব বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি খুব ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটি থেকে লভ্যাংশ পেয়েছেন সীমিত। এর মধ্যে ২০২১ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ৩২ পয়সা। এর ওপর ভিত্তি করে কোম্পানিটি আড়াই শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরে শেয়ারপ্রতি ২১ পয়সা মুনাফার ওপর ভিত্তি করে কোম্পানিটি ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়।

আর্থিক চিত্র ভালো না হওয়া ও ভালো লভ্যাংশ দিতে না পারার কারণে কোম্পানিটির শেয়ারের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কোনো আগ্রহ নেই। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কোনো বিনিয়োগ নেই।

তবে সম্প্রতি কোম্পানিটির শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বেড়েছে। এপ্রিল মাস শেষে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা এক মাস আগে অর্থাৎ মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২১ সালের জুনে ছিল ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

Advertisement

একদিকে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে ভালো ব্যবসা করতে না পারায় শাইনপুকুর সিরামিকের মূল্য আয় (পিই) অনুপাত ১৪৬ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে (১৬ মে)। ফলে কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানির আয়, পিই, লভ্যাংশসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা করা উচিত। সাধারণত পিই ২০-এর নিচে থাকা কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ উপযুক্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। পিই ২০ এর ওপর গেলে ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।

একটি কোম্পানির পিই কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিকেটর। একটি কোম্পানির পিই যত, ধরে নেওয়া হয় ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত আসতে ওই পরিমাণ বছর লাগবে। অর্থাৎ একটি কোম্পানির পিই ৫০ হলে, ওই কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত আসতে ৫০ বছর লাগবে।

তিনি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পিই ২০ পর্যন্ত আমরা ঝুঁকিমুক্ত ধরে নেই। পিই এর (২০ এর) ওপরে চলে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। তবে সব সময় পিই দিয়ে বিনিয়োগের ঝুঁকি নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। কারণ পিই নির্ধারণ করা হয় আগের বছরের আর্থিক প্রতিবেদনকে বেজ (ভিত্তি) ধরে। একটি কোম্পানির পিই বেশি হলেও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ভালো হলে তা অনেক সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয় না।

Advertisement

শুধু শাইনপুকুর নয়, সিরামিক খাতের তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির আর্থিক চিত্রের সঙ্গে শেয়ার দামের সঙ্গতি নেই। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এ খাতের শেয়ারে বিনিয়োগ করতে খুব একটা আগ্রহী নন। শেয়ারবাজারে এ খাতের পাঁচটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত। এর দুটি কোম্পানিতে নামমাত্র বিনিয়োগ আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের।

সিরামিক খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে বর্তমানে আর্থিক চিত্র সবচেয়ে খারাপ স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকের। ২০২১ সালের জুন থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় এই কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে দুই টাকা ২০ পয়সা। এমন লোকসান করার পরও কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ১৩৮ টাকা ১০ পয়সা। ফলে পিই রেশিও ৫৭৫ দশমিক ৪২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

এ প্রাতিষ্ঠানটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কোনো বিনিয়োগ নেই। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ থাকলেও তা সাম্প্রতিক সময়ে কমেছে। এপ্রিল শেষে কোম্পানিটি মোট শেয়ারের ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা মার্চে ছিল ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর গত বছরের জুনে ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।

সিরামিক খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পিই আরএকে সিরামিকের। প্রতিষ্ঠানটির পিই ২০ দশমিক ৬১ পয়েন্ট। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি ৫৭ পয়সা মুনাফা করা কোম্পানিটির শেয়ার দাম ৪৩ টাকা ৭০ পয়সা। অবশ্য এ কোম্পানিটিতেও বিদেশিদের কোনো বিনিয়োগ নেই। তবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। এপ্রিল শেষে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা মার্চে ছিল ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

বিদেশিদের বিনিয়োগ থাকা দুই কোম্পানির মধ্যে মুন্নু সিরামিকের পিই রেশিও ১১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে এক টাকা ৪ পয়সা। প্রতিটি শেয়ারের দাম ১০৩ টাকা ২০ পয়সা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে, যা গত মার্চে ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।

এছাড়া ফু-ওয়াং সিরামিকের শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। চলতি বছরের মার্চে এবং গত বছরের জুনেও কোম্পানিটির শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির শেয়ার আছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। কোম্পানিটির পিই ৫৭ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট। আর শেয়ারের দাম ১৯ টাকা ৫০ পয়সা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১৭ পয়সা

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, একটি কোম্পানির পিই ৫০০ এর ওপরে হলে ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ। আবার নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা ২৭ পয়সা, কিন্তু শেয়ার দাম ৪০-৫০ টাকা এটাতেও বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ারে কেন বিনিয়োগ করেন আমি বুঝি না। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানির আয়, লভ্যাংশ, পিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিনিয়োগের আগে কোম্পানির এসব বিষয় আবশ্যই ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে।

শাইনপুকুর সিরামিকের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শাইনপুকুর সিরামিকের দাম কেন বাড়ছে তা আমি বলতে পারবো না। আমাদের কাছে কোনো অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদশীল তথ্য নেই। মূল্য সংবেদশীল তথ্য যা আছে, আমরা প্রকাশ করেছি। সম্প্রতি শাইনপুকুর সিরামিকের শেয়ারের যে দাম বেড়েছে, আপনারা কি তাকে স্বাভাবিক মনে করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কারণ স্টক এক্সচেঞ্জ আমরা দেখি না, নিয়ন্ত্রণও করি না।

এমএএস/কেএসআর/এএসএ/এমএস