মতামত

মৌলভী বাজারের ম্যালা কিছু

মৌলভী বাজারে আমার সর্বশেষ সফরটা ছিল একেবারেই সাংগঠনিক কারণে। ঘোরাঘুরির কোনো এজেন্ডাই এতে ছিল না। সত্যি বলতে কি ঢাকা থেকে বিমানে সিলেট তারপর সড়কপথে মৌলভীবাজারের পথে দেড় ঘণ্টার যে জার্নি, তখনো কিন্তু পর্যটনের বিষয়টি আমার মাথায় ছিল না।

মৌলভীবাজারে আমার সর্বশেষ যাওয়া গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে কর্মরত আমার প্রয়াত পিতা প্রকৌশলী মাহতাব উদ্দিন আহমেদের চাকরির সুবাদে। ঢাকা সিলেটের আজকের যে মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত হতে যাচ্ছে, তার পত্তনটা আমার পিতার হাতেই।

নতুন এই মহাসড়কে সরকারি জিপ দাপিয়ে সিলেট যাওয়ায় তার যে সেকি গর্ব আর প্রশান্তি, তা আমি আজও ভুলি না। তার কর্মময় কর্মজীবনের অন্যতম অর্জন, তার ভাষায় ছিল, এই মহাসড়কটি। এই মহাসড়ক ধরেই তার সাথে সেই কবে মৌলভীবাজার যাওয়ার স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে এখন বিস্মৃতপ্রায়। তবে মনে আছে সেবার মৌলভীবাজারে সেই সময়কার জনপ্রিয় পৌর মেয়র, পরে মাননীয় মন্ত্রী, প্রয়াত মোহসিন আলী সাহেবের বাসায় দুপুরের আহার গ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সেই সময়কার তরুণ সংসদ সদস্য আর দলীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ভাই আমাদের সাথে ছিলেন সেই যাত্রায়। মৌলভীবাজার সমন্ধে এর বেশি স্মৃতির কোনো রেশ আমার স্মৃতিতে এখন আর অবশিষ্ট নেই।

এবারে ঢোলে বাড়িটা দিলেন বন্ধুপ্রতীম কবি সৌমিত্র দেব। আমার এবারের মৌলভীবাজার সফরে সঙ্গী তিনি। সম্প্রীতি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলা শাখার উদ্যোগে সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার পৌরসভা মিলনায়তনে একটি সম্প্রীতি সংলাপের আয়োজন করা হয়।

কবি সৌমিত্র দেব সম্প্রীতি বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সদস্য সচিব। সেই সুবাদেই আমাদের একসাথে এবার মৌলভীবাজারে পদার্পণ। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ওয়েস্টার্ন হোটেলে চেক ইন করে লাঞ্চ সাড়তে ঘড়ির কাঁটা বিকেল সাড়ে ৩টা ছুঁই ছুঁই। সম্প্রীতি সংলাপ শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। হাতে বেশ কিছুটা সময় আর সাথে স্ট্যান্ডবাই সিলেট থেকে ভাড়া করে আনা নোয়া মাইক্রোবাস। কাজেই সৌমিত্র দেবের ঘোরাঘুরির প্রস্তাবটা লুফে নিলাম বিনা বাক্যব্যয়ে।

আমাদের প্রথম গন্তব্য শহর থেকে কিছুটা দূরে প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিক একটি জলাধারের কোল ঘেঁষে রাঙাউটি রিসোর্ট। দারুণ জায়গা! সারি সারি লেক ফেসিং কটেজ আর লেকের মাঝে দারুণ একটা ফ্লোটিং হানিমুন কটেজ। ছুটির দিনে লোকে লোকারণ্য রাঙাউটি।

এরই মধ্যে রিসোর্টটির জেনারেল ম্যানেজার মোসাদ্দেক সাহেব এসে হাজির। ফেসবুকের কল্যাণে আমি তার খুবই চেনা। বাড়তি খাতিরের কমতি হলো না এতটুকুও। রাঙাউটি থেকে বেড়িয়ে ছুটলাম শহর পেরিয়ে, শহরের অন্যপ্রান্তে বর্ষিজোড়া ইকোপার্কে। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পার্কটির অবস্থান একেবারে মৌলভীবাজার শহরের সীমানা ঘেঁষে। শহরের এত কাছে এমন ঘন বন আর তাতে নাকি নানা প্রজাতির বসবাস, পুরো বিষয়টাই ছিল আমার চিন্তার আওতার বাইরে।

বর্ষিজোড়ায় মানুষ ছাড়া প্রাণিকুলের অন্য কোনো সদস্যের দেখা না হলেও, সবুজে ঘেরা বনাঞ্চল মনে দাগ কেটেছে গভীরে। বর্ষিজোড়া শেষে আমাদের গন্তব্য দিওরাজোড়া চা বাগান। হাতে সময় কম, কাজেই চা বাগানের ভিতরে ঢুকে ঘোরাঘুরির সুযোগটাও সীমিত। তবে গাড়ি থামিয়ে চা বাগানের খানিকটা ঘোরাঘুরি এজেন্ডা থেকে বাদ গেল না। মিটিংয়ে যাওয়ার আগে সর্বশেষ গন্তব্য মৌলভীবাজারের প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে। সৌমিত্র দেব বারবার বলছিলেন এই জায়গাটিতে যেতেই হবে। না গেলে জানতেও পারতাম না কি মারাত্মক একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করা থেকে নিজেকে নিজের অজান্তেই বঞ্চিত করে বসতাম। ইনস্টিটিউটটির প্রাঙ্গণে আছে একটি পাকিস্তানি বাঙ্কার।

একাত্তরে এটি ছিল তাদের টর্চার সেল। অসংখ্য নিরপরাধ বাঙালির জীবন আর বাঙালি বীরাঙ্গনার সম্ভ্রমের বলি হয়েছে মাত্র কয়েক ফুট বাই কয়েক ফুটের কয়েক ফুট গভীর এই বাঙ্কারটিতে। সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে পাকিস্তারি বাঙ্কারটির ভিতরে দাঁড়িয়ে সেই সব নাম না জানা শহীদদের দীর্ঘশ্বাস আজও অনুভব করা যায়!

পরদিন সকালে আমার দায়িত্ব অন্বেষা বলে স্থানীয় একটি সংগঠনের উদ্যোগে এসএসসি ও এইচএসসিতে কৃতকার্য মৌলভীবাজারের কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির দায়িত্বটি পালন করা। আবারো ঢোলে বাড়ি দিলেন সৌমিত্র দেব। মৌলভীবাজার আসবো অথচ শ্রীমঙ্গল যাবো না তা কি করে হয়? অকাট্য যুক্তি। কাজেই রাজি হতে সময় নিলাম না এক মুহূর্তও। যদিও মনে একটু হলেও সংশয় সময়মতো হাজির হতে পারবো কি না অন্বেষার অনুষ্ঠানে।

শ্রীমঙ্গলে আমাদের গন্তব্য গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টটি। বিশ্বাস করুন আমার এখনও চক্ষু মেলিয়া দেখা হয়নি, যাওয়া হয়নি হালের জনপ্রিয়তম এই রিসোর্টটিতে। গ্র্যান্ড সুলতানের গ্র্যান্ডিওর বর্ণনায় লেখার পাতা না হয় আর নষ্ট নাই করলাম। মোবাইলে এক খোঁচায় আমার লেখার চেয়ে গ্র্যান্ড সুলতানের অনেক ভালো বর্ণনা পেয়ে যাবেন যে কেউই।

গ্র্যান্ড সুলতানে যাওয়ার পথে সৌমিত্র থামালেন শ্রীমঙ্গলের বধ্যভূমিতে। ভুরভুরি ছড়ার পাশে প্রায় তিন একর জমির ওপর বিস্তৃত বধ্যভূমিটা। অসংখ্য বাঙালি মুক্তিযোদ্ধার রক্তে লাল হয়েছিল এই ভুরভুরি ছড়ার পানি ১৯৭১-এ। ছড়াটির পারে সেসব শহীদের অনেকেরই নামের ফলক মনে করিয়ে দেয় তাদের কথা, যাদের আত্মত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন। বধ্যভূমিটির মাঝখানে বিশাল একটা বটগাছ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অতি প্রিয় তীর্থ এই বটগাছটি একাত্তরে পাকিস্তানের বর্বর সেনাদের কাছে খুবই প্রিয় ছিল নিরপরাধ বাঙালিদের হত্যার জন্য।

অন্বেষার অনুষ্ঠানটি শেষে বিমানে ঢাকায় ফেরার লক্ষ্যে সিলেটের পথে যখন ফিরতি যাত্রা, স্মৃতির ভাণ্ডারে তখন অন্যরকম কিছু সঞ্চয়। মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এখানে আছে শতাধিক চা বাগান আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে শতাধিক রিসোর্ট। এসব তথ্য আমাদের কাছে পুরোনো। কিন্তু ঢাকা থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে যে আছে পিটিআই-এ পাকিস্তানি বাঙ্কার আর ভুরভুরি ছড়া, তা ছিল অন্তত আমার কাছে অজানা।

২৪ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় মৌলভীবাজারে এই ঝটিকা সফরে আমার হয়তো দেখা হয়নি অনেক লোভনীয় পর্যটন স্পট, কিন্তু আমি দেখেছি বাংলাদেশকে! বিমান যখন সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে ঢাকার পথে ডানা মেলছে তখন বারবার এমনটাই মনে হচ্ছিল।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস