বিশেষ প্রতিবেদন

মাইকিং করে জাটকা বিক্রি, নিশ্চুপ প্রশাসন

মেলা মেলা মেলা! জাটকা ইলিশের মেলা। প্রতি কেজি ইলিশ মাত্র দুই শত টাকা। যারা কম দামে ইলিশ কিনতে চান, তারা আজ সন্ধ্যায় চলে আসুন বরগুনা মাছ বাজারে।’ বরগুনায় এভাবে প্রতিদিনই মাইকিং করে বিক্রি করা হচ্ছে জাটকা (৯ ইঞ্চির ছোট ইলিশ)। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে জাটকা বিক্রি হলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না প্রশাসন। অন্যদিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমে বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে কয়েক হাজার জেলে জাটকা নিধন করলেও রহস্যজনক কারণে নিশ্চুপ জেলা মৎস্য বিভাগ। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বরগুনার সচেতন মহল।বরগুনা জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৯ ইঞ্চির ছোট ইলিশ ধরা, বিক্রয়, মজুদ ও পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। জাটকা সংরক্ষণের এ সময় প্রতি জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। বরগুনায় প্রায় ১২ হাজার জেলেকে এ খাদ্য সহায়তার আওতায় আনা হয়েছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাটকা সংরক্ষণ মৌসুমে নদীতে বড় ইলিশের তুলনায় জাটকা বেশি পাওয়ায় সরকারি সহায়তার পাওয়ার পরও এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কয়েক হাজার জেলে বরগুনার পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীতে অবাধে তিন থেকে সাত ইঞ্চি আকারের জাটকা শিকার করছেন। পরে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এসব জাটকা প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে। একটু বেশি দামের আশায় অনেকে আবার এ জাটকা বিক্রি করছেন বাড়ি বাড়ি গিয়েও। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, কোস্টগার্ড এবং মৎস্য বিভাগ এখন পর্যন্ত জাটকা রক্ষার্থে কোনো অভিযান শুরু না করায় জেলেরা নির্বিঘ্নে দিন-রাত নদীতে জাল ফেলে জাটকা শিকার করছে।বরগুনার বড়ইতলা ফেরি ঘাট ও আমতলী ফেরি ঘাট গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা ছোট-ছোট নৌকা নিয়ে জাটকা ধরছে। প্রতিবার জাল টেনে তুলতেই উঠে আসছে শত শত জাটকা যা কিছুদিন পরই পরিণত হতো ইলিশ মাছে।এ ব্যাপারে জেলে তবির উদ্দিন, কালাম দফাদার ও কাকন মিয়া জাগো নিউজকে জানান, এনজিও এর কিস্তির টাকা জোগাড় এবং দাদনদাতাদের নির্দেশে জাটকা শিকার বেআইনী জেনেও এই অপরাধ করছেন তারা। আর আবুল ও কবির নামের দুই জেলে জাগো নিউজকে জানান, সবাই জাটকা শিকার করছে তাই তারাও করছেন। জাটকা শিকার করা বেআইনি, তারপরও কেন শিকার করছেন? জাগো নিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, এ মাছ ধরলে কেওতো কিছু কয়না (বলেনা)।বরগুনার বগী, পচাঁকোড়ালিয়া, গোলবুনিয়া, আমতলী বাজার ঘুরে ও পাথরঘাটা, তালতলী এবং কাকটিড়া বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশ্যে এসব বাজারে জাটকা বিক্রি করা হচ্ছে। দামে কম থাকায় বাজারে এর চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। এসব বাজারে প্রতিদিন যে পরিমাণে মাছ বিক্রি হয় তার সিংহভাগই জাটকা।বরগুনা মাছ বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, জাটকার পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। ইলিশের মেলা উপলক্ষে বাজারে সমাগম হয়েছে ব্যাপক ক্রেতারও। দুইশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে পাঁচ ইঞ্চির ছোট জাটকা। এ জাটকা প্রতি কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে ৫-৬ টা করে। আর নয় ইঞ্চির ছোট জাটকা বিক্রি হচ্ছে দুইশ ৫০ টাকা করে। এগুলো পাওয়া যাচ্ছে কেজিতে ৩-৪টা করে। আর হালি (চারটি) বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায়।এ সময় জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় আবদুস সাত্তার (৫০) নামে এক ক্রেতার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ইলিশ মাছের মেলা শুনে রাতে বাজারে এসেছিলাম। কিন্তু এখনতো দেখি ইলিশ কম সবই জাটকা। এ জাটকার স্বাদ আর ইলিশের স্বাদ এক রকম না। তাই স্বাদের বিবেচনায় কম দামে ইলিশ না কিনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।লতিফ (৩৫) নামের আরেক ক্রেতা জাগো নিউজকে জানান, কাজের কারণে দিনে বাজার করার সময় পায় না। তাই রাতে বাজারে এসেছি। জাটকা কিনেছেন কেন?  এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আন্য মাছের তুলনায় এ মাছের দাম অনেক কম তাই কিনেছি।আর জাটকা বিক্রেতা আবুল, সাত্তার এবং রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দোষ কি? আমরা তো এ মাছ নদীতে ধরতে যাই না। যারা ধরে তাগোরে (তাদের) কিছু কন (বলেন) না ক্যান?। তারা এ মাছ না ধরলেই তো পারে। এ মাছ যারা ধরে, দোষতো তাগো। আমাগো দোষ কি? ভাই, মাছ বেইচ্চা সংসার চালাই। বাজারে এহন এই মাছ বেশি আসে এবং এ মাছের দাম কম হওয়ায় চাহিদাও বেশ ভালো। তাই আমরা এই মাছ বেচি। এতে যা লাভ হয় তা দিয়েই সংসার চালায়।জানা গেছে, জেলেদের কাছ থেকে পাইকারা প্রথমে জাটকা সংগ্রহ করেন। এরপর পাইকারদের কাছ থেকে এসব জাটকা সংগ্রহ করেন আড়তদাররা। পরে আড়তদারদের কাছ থেকে জাটকা সংগ্রহ করে সেগুলো বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন খুচরা বিক্রেতারা।এ বিষয়ে বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সস্পাদক আবু জাফর মো. সালেহ জাগো নিউজকে বলেন, জাটকা শিকারি অসাধু জেলে ও জাটকা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জেলা মৎস্য বিভাগের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা জেলা মৎস্য বিভাগের যোগসাজশে বরগুনা জেলা শহরে মাইকিং করে প্রকাশ্যে জাটকা বিক্রি করছে।বরগুনা সদর উপজেলার নলী বন্দর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আবদুল মালেক জাগো নিউজকে জানান, এবার বরগুনায় মা ইলিশ রক্ষা অভিযান সফল হওয়ায় নদীতে প্রচুর পরিমাণ জাটকার দেখা মিলছে। কিন্তু বেশ কিছু জেলে কারেন্ট জাল দিয়ে জাটকা নিধন করছে। তাই এখনই যদি জাটকা নিধন রোধ করা না হয় তাহলে বিষখালী নদী আবারও ইলিশশূন্য হয়ে পড়বে।মৎস্য বিভাগের উপর আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসেন আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা মাছের বিভিন্ন আড়ত ও জেলে পল্লিতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনার মাধ্যমে জেলেদের জাটকা নিধন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা জানুয়ারি মাসে পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীতে ১০৬টি অভিযান পরিচালনা করেছি। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে ৫৮টি। এ সময় ২৭৭টি বেহেন্দী জাল, ৩০০টি খোটা জাল, ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৩০০মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করেছি।এছাড়াও তিন লাখ ১২ হাজার ৭০০ মিটার অন্যান্য জাল জব্দ করেছি। এ সময় জাটকা শিকারের দায়ে ১৭ হাজার টাকা জরিমানাও আদায় করা হয়েছে জেলেদের কাছ থেকে। আর বরগুনার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৫৫৮ কেজি জাটকা জব্দ করেছি। তবে বর্তমানে জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক ড. মহা. বশিরুল আলম জাগো নিউজকে জানান, ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ। তাই একে রক্ষার জন্য আমদের যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তা সবই গ্রহণ করবো। এ মসয় জেলা মৎস্য বিভাগের উপর আনা অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন বলেও জানান তিনি।এসএস/পিআর