অর্থনীতি

বিকাশ পরিবারে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছেন হাজারো গ্রাহক

দেশের শীর্ষ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। ২০১১ সালে কার্যক্রম শুরুর পর ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির আকার বড় হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে বাড়ছে গ্রাহক সংখ্যা। এরইমধ্যে বিকাশের নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১১ বছরের যাত্রায় মিলেছে বেশকিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশ থেকে ৭৫টি আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার সংস্থার মাধ্যমে প্রবাসীরা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন দেশে।

ব্যাংক হিসাবের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু করা, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও চীনের আলিবাবা গ্রুপের অঙ্গ সংস্থা আলিপের অংশীদার হওয়া এবং বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের বিনিয়োগকারী হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বিকাশের সিইও কামাল কাদীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।

জাগো নিউজ: মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১১ সালে কার্যক্রম শুরু করে বিকাশ। শুরুর দিকে আপনাদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে?

কামাল কাদীর: সাধারণ মানুষের আর্থিক লেনদেন সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স পেয়ে যাত্রা শুরুর পর থেকে মোবাইল আর্থিক সেবাকে দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলার প্রয়াস চালিয়ে গেছে বিকাশ। তাই এখন ব্যাংকিং সেবার বাইরে এবং ভেতরে থাকা কোটি জনসাধারণ এমএফএসের মাধ্যমে টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে কেনাকাটা, মোবাইল রিচার্জ, ইউটিলিটি বিল, টিকিট কেনা, সরকারি ফি প্রদান, ব্যাংকের মাধ্যমে লোন, সেভিংসের মতো সেবা নিচ্ছেন প্রতিদিন।

শুরুর দিকে, একটা ফিচার ফোন ব্যবহার করে মুহূর্তেই যে টাকা পাঠানো যায়- এই নিয়ে গ্রাহকের আস্থা তৈরি করাই ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা পৌঁছে দিতে দেশের প্রতিটি প্রান্তে এজেন্ট নেটওয়ার্ক তৈরি ও পরিচালনা, গ্রাহকদের প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন নতুন লেনদেন সেবার সঙ্গে পরিচিতি ও সচেতনতা তৈরি এবং সবাইকে যুক্ত করে ডিজিটাল লেনদেনের ইকো-সিস্টেম তৈরিতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিকাশ।

জাগো নিউজ: বর্তমানে বিকাশের গ্রাহক সংখ্যা কত এবং কতজন এজেন্ট আছে? বিকাশের গ্রাহকদের মধ্যে কোন শ্রেণির মানুষ বেশি?

কামাল কাদীর: ১১ বছরের পথচলায় বিকাশ পরিবারে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছেন হাজারো গ্রাহক। এই মুহূর্তে বিকাশের নিবন্ধিত গ্রাহক ছয় কোটি ৩০ লাখ। এই বিশাল সংখ্যক গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে সারাদেশে ছড়িয়ে আছে হিউম্যান এটিএম খ্যাত ৩ লাখ বিকাশ এজেন্ট। পাশাপাশি দুই লাখ ৬০ হাজার মার্চেন্ট, দেশের সব শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউটিলিটি সেবাদানকারী কর্তৃপক্ষসহ বহু প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের সঙ্গে গ্রাহকের আর্থিক লেনদেন সহজ, নিরাপদ ও ঝামেলাহীন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বিকাশ। ফলে ব্যাংক সেবার বাইরে এবং ভেতরে থাকা সবার প্রতিদিনকার আর্থিক লেনদেনে আরও স্বাধীনতা ও সক্ষমতা দেওয়ার জন্য কাজ করছে বিকাশ। তাই বিকাশ এখন দেশের প্রতিটি পরিবারের সদস্য।

জাগো নিউজ: ব্যাংক হিসাবের বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা কোথা থেকে পান?

কামাল কাদীর: আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগেও ব্যাংক সেবার আওতায় ছিল দেশের অল্প সংখ্যক মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক লেনদেন ছিল জটিল ও ব্যয়বহুল। শহর থেকে গ্রামে পরিবারের সদস্যদের কাছে উপার্জনের অর্থ পাঠাতেই প্রচুর সময় ও টাকা ব্যয় হতো। তাই হাতে টাকা থাকার পরও লেনদেনের কার্যকর কোনো মাধ্যম না থাকার কারণে অনেক জরুরি সময়ও সেই টাকা কাজে আসেনি। এ সমস্যা সমাধানের উপায় হতে পারে মোবাইল ফোন, যেহেতু ততদিনে ফোন পৌঁছে গেছে সবার হাতে দেশজুড়ে। এটাকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে আর্থিক সেবার বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীকে লেনদেন সেবার আওতায় নিয়ে আসা যায়- সেই ভাবনা থেকেই নতুন কিছু করার চিন্তা। উৎসাহ দিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

এজন্য ২০০৮ সালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে সেখানে চালু হওয়া মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের আইডিয়াটি বুঝতে চেষ্টা করলাম। এদিকে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার তখন প্রযুক্তিনির্ভর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দিকে নজর দিচ্ছে। এ সময় বিশেষ আগ্রহ দেখালেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সব দিক থেকেই কাজ এগিয়ে গেলো। মানি ইন মোশন এলএলসি এবং ব্র্যাক ব্যাংকের যৌথ অংশীদারত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়ে ২০১১ সালের ২১ জুলাই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে বিকাশ।

জাগো নিউজ: কার্যক্রম শুরুর পর বিকাশ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছে। এসব পুরস্কার বিকাশের কার্যক্রম সম্প্রসারণে কতটা ভূমিকা রেখেছে?

কামাল কাদীর: যেকোনো পুরস্কার এক ধরনের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত আরও ভালো কিছু করার প্রেরণা জোগায়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে তথা দেশের অর্থনীতিতে অবদানের জন্য গত ১১ বছরের যাত্রায় বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বিকাশ। তার মধ্যে অন্যতম বিশ্বখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিনের ২০১৭ সালের ‘কোম্পানিজ দ্যাট আর চেঞ্জিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় বিশ্বসেরা ৫০টি কোম্পানির মধ্যে ২৩তম স্থান অর্জন, বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম পরিচালিত ভোক্তা জরিপে ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে টানা তিনবার দেশসেরা ব্র্যান্ড, নিয়েলসন পরিচালিত ক্যাম্পাস ট্র্যাক সার্ভে-২০২০ ও ২০২১ এ পর পর দুবার স্বনামধন্য বহুজাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে সেরা ‘এমপ্লয়ার অব চয়েস’ এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ‘ডিএইচএল-দ্য ডেইলি স্টার- বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড’-এ ২০২১ সালের ‘বেস্ট ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় বিকাশ।

জাগো নিউজ: প্রথম কোনো এমএফএস প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বেস্ট ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অব দ্য ইয়ার’ অর্জন করেছে বিকাশ। এ বিষয়ে কিছু বলুন।

কামাল কাদীর: স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে সঙ্গে নিয়ে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে। এই গতির সাথে তাল মিলিয়ে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে বিকাশ নিরলসভাবে কাজ করছে ব্যাংক সেবার বাইরে এবং ভেতরে থাকা জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনকার লেনদেনে আরও সক্ষমতা ও স্বাধীনতা এনে দিয়ে কার্যকর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে। সরকারের ডিজিটাল রূপকল্পের সাথে একাত্ম হয়ে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন থেকে আধুনিকতম প্রযুক্তির ব্যবহারে গ্রাহকবান্ধব সেবা প্রদান এবং করপোরেট সুশাসন বজায় রাখার স্বীকৃতি আজকের এই অর্জন। ক্যাশবিহীন ইকোসিস্টেম এবং কার্যকর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় সবসময়ই পাশে থাকবে বিকাশ।

জাগো নিউজ: আমেরিকার মানি ইন মোশন এলএলসি এবং ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগ হিসেবে ২০১১ সালে বিকাশের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ও চীনের আলিবাবা গ্রুপের অঙ্গ সংস্থা আলিপের অংশীদার হওয়া এবং বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের বিনিয়োগকারী হওয়া বিকাশের কার্যক্রমে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে?

কামাল কাদীর: অংশীদার বাছাই এবং তাদের কী ধরনের ভূমিকা থাকবে, এ নিয়ে বিকাশ কিন্তু প্রথম থেকেই বেশ সতর্ক। যেমন- ব্র্যাক ব্যাংক মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই) কেন্দ্র করে কার্যক্রম চালায়, আবার আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। ফলে ব্র্যাক ব্যাংকের যুক্ততা থেকে কেবল যে একটি ভালো পরিচালন ব্যবস্থা পেয়েছি তা নয় বরং অন্তর্ভুক্ত হওয়ার একটি সংস্কৃতিও তাদের কাছ থেকে পেয়েছি। মানি ইন মোশন এলএলসি, এর শুরুর উদ্যোক্তা। কোম্পানিটি মোবাইল আর্থিক সেবার ব্যবসাটি বোঝে, এমন লোকগুলোকে জড়ো করেছে। এমনিতে মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে একটি সম্পর্ক মানি ইন মোশনের আগেই ছিল।

আইএফসি বিশ্বব্যাপী ভালো ও দক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত, যা একটি ভালো করপোরেট পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গবেষণা এবং এর বিদ্যমান প্রবণতা বা ধারা বিশ্লেষণে সম্পৃক্ত। বিশ্বের কোথায় কী ধরনের সেবা চলছে এবং তার ফল কী— এ নিয়ে তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। আর আলিবাবা গ্রুপ সেরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। প্রযুক্তি খাতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী জাপানের সফটব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ কেবল বিকাশের অবদানের প্রতি স্বীকৃতিই নয় বরং দেশের আরও সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানে ভালো বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত করলো।

জাগো নিউজ: বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আনতেও বিকাশ ভূমিকা রাখছে। কখন বিকাশ এ কার্যক্রম শুরু করে এবং শুরুতে কেমন সাড়া পাওয়া যায়? বর্তমানে কতোটি দেশ থেকে প্রবাসীরা বিকাশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন?

কামাল কাদীর: প্রবাসীরা কাজের সময় নষ্ট না করে যখন প্রয়োজন তখনই দেশে থাকা প্রিয়জনের বিকাশ অ্যাকাউন্টে মুহূর্তেই তার কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়ে দেওয়ার সুবিধা পান বলেই অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিকাশের মতো এমএফএসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর এই সেবা। বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশ থেকে ৭৫টি আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার সংস্থার মাধ্যমে ১২টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে সেটেলমেন্ট হয়ে মুহূর্তেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স পৌঁছে যাচ্ছে প্রিয়জনের বিকাশ অ্যাকাউন্টে। রেমিটলি, ট্যাপ ট্যাপ সেন্ড, ওয়ার্ল্ড রেমিট, ওয়াইজ, রিয়া, মার্চেন্ট্রেড, গালফ এক্সচেঞ্জ, বাহরাইন ফিন্যান্সিং কোম্পানি (বিএফসি), সোনালী এক্সচেঞ্জ, সিবিএল মানি ট্রান্সফার, অগ্রণী এক্সচেঞ্জ, এনবিএল এক্সচেঞ্জের মতো অর্থ স্থানান্তর প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সহজেই বিকাশ হিসাবে টাকা পাঠানোর সেবা সময় সাশ্রয় করাসহ নানান সুবিধা দেয় প্রবাসীদের।

জাগো নিউজ: জাগো নিউজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

কামাল কাদীর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।

এমএএস/এসএইচএস/এমএস