খেলাধুলা

ক্যারিবীয় ক্রিকেটের নতুন সূর্যোদয়!

১৯৮৩ সাল থেকে ২০১৬- ব্যবধান ৩৩ বছরের। অনেকেই বলেন, ১৯৮৩ সালেই দিগন্তের অস্তাচলে হারিয়ে গিয়েছিল ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সাম্রাজ্য। সেবারই ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটে গিয়েছিল। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিল তখনকার ক্রিকেটের মহা পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিকেটে বিশ্বকাপের ধারানাটা আসার পর থেকেই যেন অপ্রতিরোধ্য, দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে দিগ্বিজয়ী। সেই ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যকেই লর্ডসে পদানত করে দিয়েছিল কপিল দেবের ভারত।কী ছিল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটিতে! শক্তি, সামর্থ্য, গ্ল্যামার, কিংবদন্তী। এক কথায় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা দল। ক্লাইভ লয়েড তো ছিলেন। ক্রিকেটের অন্যতম সেরা মস্তিষ্ক। ওপেনিংয়ে গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স। এরপর ভিভ রিচার্ডস। যার নাম শুনলেই কেঁপে উঠতো প্রতিপক্ষ বোলারদের বুক। বল হাতে অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং। প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপে মুহুর্তে কাঁপ ধরিয়ে দিতেন যারা। বিশ্বের অন্যতম সেরা ভয়ঙ্কর বোলিং লাইনআপ।সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই কি না কপিল দেবের নড়বড়ে ভারত হারিয়ে দিল ৪৩ রানের ব্যবধানে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট বোদ্ধারা হিসেব কষতে বসে গিয়েছিলেন- যে কিভাবে সম্ভব! এমন একটি ক্যরিবীয় দলকে ভারতের পক্ষে হারানো সম্ভব। তাও বোলাররা যখন ভারতকে অলআউট করে দিয়েছিল মাত্র ১৮৩ রানে।টানা তৃতীয়বারেরমত বিশ্বকাপ হাতে উঠছে লয়েডের এটা নিশ্চিত ধরেই নিয়েছিল সবাই; কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, কপিল দেবের অসাধারণ নেতৃত্বের গুণে ভারতই চ্যাম্পিয়ন। লর্ডসের ব্যালকনিতে শিরোপা ওঠালেন কপিলই। মহিন্দর অমরনাথ, মদন লাল, রজার বিনি, বালবিন্দর সান্ধুরা ওইদিন ক্যারিবীয় পতাকাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে আনে। ক্রিকেট পাহল ক্যারিবিয়ানরাও বুঝি ওই হারের পর ক্রিকেট থেকে তখনই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কারণ, এরপর গত ৩৩টি বছর পার হয়ে গেলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কোথাও তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ব্যক্তিগতভাবে হয়তো ব্রায়ান লারা, কোর্টনি ওয়ালশরা কিছুদিন ক্যরিবীয় পতাকাটা বহন করেছিলেন। কিন্তু সেটা দলগতভাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মত নয়। দেশটির ক্রিকেটেও অর্থনৈতিক অবস্থাতে ভাটার টান। বাধ্য হয়ে ক্যারিবীয়রা টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্রাঞ্জাইজিভিত্তিক ক্রিকেট খেলতে বেরিয়ে পড়ে। যার কারণে একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা উঠলো গেইল-স্যামিদের হাতে।যদিও তাকে আসল ক্রিকেট বলতে নারাজ অনেকেই। বরং, বোর্ডের সঙ্গে খেলোয়াড়দের একের পর এক দ্বন্দ্ব ক্যারিবীয় ক্রিকেটকে তলানীতেই এনে ঠেকিয়েছে যেন। এরই মাঝে যে একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তারা গড়ে তুলছে, তা কে জানতো! নাকি আচমকাই ক্যারিবীয়রা জ্বলে উঠছে নিজেদের হারানো আত্মগরিমা জাগিয়ে তুলে! কয়েকদিন আগেই অবসররের ঘোষণা দিয়েছিলেন শিব নারায়ন চন্দরপল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। তখনই লিখেছিলাম, নিভে গেলো ক্যারিবীয় ক্রিকেটের শেষ বাতিটিও`; কিন্তু সেটা যে নিচকই একটা ধারণা, তার প্রমাণ দিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের যুব ক্রিকেটাররা। সেই ১৯৮৩ সালের পর আবারও বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভেন্যু লর্ডসের পরিবর্তে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। এবার ৩৩ বছর আগের মতই প্রায় পরিস্থিতি। ধরনটা যা উল্টো। সেবার পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এবার ভারত। ফরম্যাটটা একই। তবে অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের ক্রিকেট। রাহুল দ্রাবিড়ের অভিভাবকত্বে যে দলটি দুর্দান্ত খেলে আসছিল টুর্নামেন্টের প্রথম থেকে। সবাই ভাবছিল, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেয়ে চতুর্থবারেরমত চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি তুলে নেবে ভারতই।আগেরদিনই আনন্দবাজার থেকে শুরু করে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার সূর ছিল, ১৯৮৩ বিশ্বকাপকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০১৬`র মিরপুরের এই ফাইনাল। সেবার কপিল দেব যেভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পদানত করেছিল, এবার ফেভারিট হয়ে সেই ইতিহাসটাকেই পূনরাবৃত্তি করতে চায় ঈশান কিশানরা। রাহুল দ্রাবিড়ের কাছ থেকে নাকি সেই ইতিহাসের গল্প শুনে আরও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে ভারত।কিন্তু ক্রিকেট তো সব সময়ই গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। কোন দিনটা ক্রিকেট কাকে উপহার দেবে, সেটা কেউ বলতে পারে না। দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে আসছিল বাংলাদেশও; কিন্তু মেহেদি হাসান মিরাজরাও তো পারেনি সেমিফাইনালে এসে। তারা মেনে নিয়েছিল, দিনটা তাদের ছিল না। মিরপুরে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিবসটিও ভারতের ছিল না হয়তো। যেমনটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ছিল না ১৯৮৩ সালে ২৫ জুন লর্ডসের  দিনটিও। সেবার যদি ভারতের কাছে হেরে ক্যরিবীয় সূর্যাস্তের লগ্ন শুরু হয়ে থাকে, তবে কী ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিরপুর থেকে আবার সেই সাম্রাজ্যের পতাকা উদিত হতে শুরু করেছে! ভারতের শক্তিশালি ব্যাটিং লাইনআপকে ১৪৫ রানে গুঁড়িয়ে দিয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে ম্যাচটি বের করে আনাই প্রমাণ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখনও কতটা পেশাদার।শিমরন হেতমায়ের, শ্যামার স্প্রিঙ্গার, রায়ান জনরা হয়তো এখনও অনুর্ধ্ব-১৯-এর ক্রিকেটার। তবে এই বয়সেই যে আত্মবিশ্বাসের বীজ রোপন হয়ে গেছে তাদের হৃদয়ে, সেটা যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড যথাযতভাবে অঙ্কুরিত করতে পারে, তাহলে নিশ্চিত, লয়েড, রিচার্ডসদের হারানো পতাকা আবারও উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারবে ক্যারিবীয়রা।আর রাহুল দ্রাবিড়দের মুখে কপিল দেবের গল্প শুনতে শুনতে ৩৩ বছর পেছনে চলে যাওয়া ইশান কিশানরা যে ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি করতে চেয়েছিল, তা তো তারা পারেইনি। বরং, ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে বড় একটা ধাক্কা খেয়ে গেলো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে ভারতের প্রয়োজন, এই ম্যাচটিকে ভূলিয়ে দিয়ে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ারন পথ সৃষ্টি করা।আইএইচএস/এমএস