দেশজুড়ে

৩৫ বছর পরেও ধুঁকছে গাইবান্ধার বিসিক শিল্পনগরী

২০১১ সালে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের পর বিদ্যুতের অভাবে গাইবান্ধা বিসিক শিল্পনগরীতে তার কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে পারেননি উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০১৬ সালে বিসিক কর্তৃপক্ষ ট্রান্সফরমার মেরামত করতে সফল হয়। ততক্ষণে কারখানার সব কর্মচারী চলে যাওয়ায় তিনি আর কারখানার একটি মেশিনও চালু করতে পারেননি। কারখানায় বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে ফেলে এবং তার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় আনোয়ার হোসেনের।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কারখানা শুরু করার জন্য আমি ৩৮ লাখ টাকা ব্যাংক লোন নিয়েছিলাম। গত বছর আমি আমার জায়গা জমি বিক্রি করে সুদসহ ৪৮ লাখ টাকা শোধ করেছি। এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার।

গাইবান্ধা বিসিকে বিদ্যুতের অভাবে আনোয়ারের মতো আরও বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তাও একই দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। ২০১৬ সালে বিসিক শিল্পনগরীর পাশে ২০ মেগাওয়াট সাব-স্টেশন স্থাপনের পর বিদ্যুৎ সংকট কেটে গেলেও ৩৫ বছরের পুরোনো শিল্পনগরীর সার্বিক পরিস্থিতি এখনও খুব বেশি উন্নত হয়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, গাইবান্ধা বিসিক শিল্পনগরীটি আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। তাই সড়কপথে সহজে পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। তবে এখানকার অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো খুবই সরু। একটি যানবাহন মহাসড়কে ২০-২৫ টন মালামাল বহন করতে পারে। কিন্তু বিসিক এলাকার রাস্তাগুলো ১০ টনের বেশি পণ্যবাহী যানবাহনের জন্য উপযুক্ত নয়। এই শিল্পনগরীতে ১০৫টি প্লট রয়েছে। সেখানে স্থাপিত ৫৩টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে ২১টি বিভিন্ন কারণে বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে নেই গ্যাস সংযোগ, দুর্বল সড়ক অবকাঠামো, যোগ্য ব্যক্তিদের প্লট বরাদ্দ না হওয়া, ব্যাংকের ঋণ দিতে অনীহা, সীমানা প্রাচীর না থাকায় নিরাপত্তার অভাব এবং অপর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা।

সার ও কীটনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিয়াম ক্রপ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী সাদেকুল ইসলাম বলেন, প্রতিটি কারখানা থেকে বছরে ৯ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ বিসিককে দিতে হয়। কারখানাগুলোর সামনের ড্রেন সবসময় দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ভরে থাকে। আমরা কর্তৃপক্ষকে সমস্যার কথা জানিয়েছি, কিন্তু কর্তৃপক্ষ সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বিসিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহিদুজ্জোহা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকটি তেল কারখানা ও একটি পাটকল ছাড়া বাকি সব কারখানাই কোনো না কোনো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এখানে প্রায় ২০০ জন শ্রমিক নিয়ে পাঁচটি সরিষার তেল উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মণ সরিষার প্রয়োজন হয়। প্রায় ৭ হাজার কেজি তেল উৎপাদন হয়। এই কারখানাগুলো ভালো চলছে। কিন্তু অন্যান্য কারখানায় তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে সমস্যায় আছেন।

কথা হয় গাইবান্ধা বিসিক মালিক সমিতির সভাপতি প্রতাপ ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ শিল্প নগরীর অবকাঠামোগত মান খুবই খারাপ। এখানে গ্যাস সংযোগ নেই। নেই বর্জ্য শোধনাগার। ডাম্পিং ইয়ার্ড, এমনকি ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমও নেই। কখনও কখনও, পুকুর বা জলাশয় না থাকায় পানির সংকটের সম্মুখীন হতে হয়।

নিরাপত্তা প্রহরী আসলাম আলী তার পরিবার নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া যমুনা মেলামাইন কোম্পানি নামের একটি কারখানায় বসবাস করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এই কারখানাটি দুই বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ। যে কারণে আমরা বর্তমানে এটিতে বসবাস করছি। তবে শুনছি কারখানাটি আবার চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, জলাবদ্ধতার কারণে বৃষ্টির সময় এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। বিসিকে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই, ফলে কারখানাগুলো অরক্ষিত থাকে।

বিসিক গাইবান্ধার তথ্যমতে, শিল্পনগরীর অন্তত ১৪টি কারখানা বহু বছর ধরে বন্ধ। কর্তৃপক্ষকে তাদের কারখানা পুনরায় চালুর জন্য সরকারিভাবে একাধিকবার বলা হলেও এখনও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বিসিকের সহকারী উপ-মহাব্যবস্থাপক রবীন চন্দ্র রায় জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাস সংকট ও দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না গাইবান্ধা বিসিক। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্লটের মালিকানা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। বন্ধ থাকা কারখানাগুলো চালুর জন্য উদ্যোক্তাদের একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে।

১৫ একর জমির ওপর ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত গাইবান্ধা বিসিক শিল্পনগরীতে এখন ১০৫টি প্লট রয়েছে। সরকার বছরে ৬৫.৯৬ কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও এখানে রপ্তানিমুখী কোনো কারখানা নেই।

এসএইচএস/এএসএম