ধর্ম

দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)

দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)

মোহাম্মাদ হাসিব উল্লাহ

Advertisement

যুগে যুগে যারা ইসলামের জন্য বেশি বেশি অবদান রেখেছেন, তাদের অন্যতম ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ছিলেন মুজাদ্দিদ, একজন ফকিহ ও যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। ঠিক কোরআনের ঘোষণার মতোই দ্বীনের একজন দাঈ ছিলেন তিনি। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন-

اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّك بِالۡحِکۡمَة وَالۡمَوۡعِظَة الۡحَسَنَة

‘তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর।’ (সুরা নাহল : আয়াত ১২৫)

Advertisement

অনুরূপ, তিনিও মানুষকে হেকমতের সহিত ইসলামের বিধি-বিধান সঠিকভাবে পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বাতিলের মোকাবেলায় দ্বীন ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একজন যোগ্য দাঈ হিসেবে জীবনের পরতে পরতে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

ইসলামের এই প্রখ্যাত আলেম ১৬৪ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি মেধাবী ছিলেন এবং জ্ঞান অর্জনের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। শৈশবে ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রসিদ্ধ ছাত্র কাজি আবু ইউসুফ রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাছে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি ঘটে।

বাল্যকালেই তিনি পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। বাগদাদে বসবাসের সুবাদে তিনি সে যুগের বড় বড় আলেম, ফকিহ ও মুহাদ্দিসগণের সান্নিধ্য পান। তার প্রসিদ্ধ শিক্ষকদের মধ্যে কাজী আবু ইউসুফ, হুশাইম ইবনে বশীর, ইমাম আশ-শাফেয়ী, সুফিয়ান ইবনে উয়াইয়ানাহ এবং ওয়াকী ইবনুল জাররাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমূখ উল্লেখযোগ্য।

Advertisement

হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুসনাদে আহমাদ’ রচনার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। এই সংকলনের কাজে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন, বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ আহরণ করেছেন। তন্মধ্যে ইরাক, ইয়ামান, হিজাজ, সিরিয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এমনকি ইমাম শাফেঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেও হাদিসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে তাঁর শরণাপন্ন হতেন। হাদিস বিশারদগণের মতে, ‘মুসনাদের প্রায় ত্রিশ হাজার হাদিস লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং দশ হাজার হাদিসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। পাশাপাশি, জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবি অর্থাৎ ‘আশারায়ে মুবাশ্বারা’ সাহাবিদের মুসনাদ প্রথমে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা প্রতিটি যুগে ও শতাব্দীতে বহু মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেছেন। যেমন খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ, ইমাম শাফেঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রমুখ সবিশেষ বিভিন্ন শতাব্দীতে মুজাদ্দিদ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহিও ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ। যিনি দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী ও মুজাদ্দিদ হিসেবে ব্যক্তিজীবনে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া মুজাদ্দিদ প্রেরণ সম্পর্কেও হাদিসে একাধিক বর্ণনায় এসেছে-

قال رَسُولِ اللَّهِ (صلى الله): ”إِنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এই উম্মাতের জন্য প্রতি একশত বছরের প্রথম ভাগে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মাতের দ্বীনকে তার জন্য সঞ্জীবিত করবেন।’ (আবু দাউদ ৪২৯১)

ফলশ্রুতিতে, ইমাম আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘কোরআন আল্লাহর বাণী নয়, বরং সৃষ্ট’- মুতাজিলাদের এই দাবির বিরোধিতা করায় রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি খলিফা আল-মামুনের রোষানলের শিকার হয়েছেন। কারণ, তৎকালীন খলীফা আল-মামুনও মুতাজিলা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য প্রদান করে যে, ‘খলিফা আল-মামুন’ থেকে শুরু করে খলিফা মুতাসিম, আল-ওয়াসিক প্রমুখের শাসনামলে তিনি অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একবার রাজ দরবার থেকে তাকে টেনে হিচড়ে একটা রুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তাঁকে প্রহার করা হতো। এভাবে তাকে প্রায়  আটাশ মাস কারাগারে নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। তবুও ইমাম আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার বক্তব্যে অনড় ছিলেন। তিনি দ্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘কোরআন আল্লাহর বাণী।’ তবে খলীফা মুতাওয়াক্কিল যখন খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তিনি তাঁর উপর থেকে নির্যাতনের ধারা তুলে নেন এবং সহানুভূতিশীল আচরণ প্রদর্শন করেন।

তাঁর জীবনী থেকে জানা যায়, ‘ইমাম শাফেঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি একবার তাঁর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেন-

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার স্বপ্নে এসেছিলেন। তিনি আপনার প্রতি সালাম জানিয়েছেন এবং বললেন, আল্লাহ আহমাদকে পরীক্ষা করবেন। সে যেন আল্লাহর পথে সব সময় অবিচল থাকেন, বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হয়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে আখেরাতে মর্যাদার আসনে আসীন করবেন।’

ইমাম শাফেই রহমাতুল্লাহি আলাইহির চিঠি পড়ে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি কেঁদে ফেললেন। তিনি জীবনে এক মহা অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে শুরু করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিলো, ‘আল্লাহ সব সময় তাকে সাহায্য করবেন।’ এভাবে ইমাম আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার মাধ্যমে ঈমানের প্রতিটি অগ্নি পরীক্ষায় সফলতা অর্জন করেন।

তার সামাজিক মতাদর্শ হচ্ছে, ‘সমগ্র জাতির মধ্যে ঐক্য বিরাজ করবে। ঐক্য বিনষ্টকারীদের থেকে দূরে থাকতে হবে এবং বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’ তাঁর মতে, কবিরা গুনাহের ভিত্তিতে হাদিসের কোনো প্রমাণ ছাড়া কাউকে কাফের ঘোষণা করা যাবে না। তিনি কেবল তিনটি ক্ষেত্রে কাফের ফতোয়া দেওয়া বৈধ মনে করেন। যথা-

১. নামাজ ত্যাগ করা।

২. শূরা বা মদ পান করা।

৩. এমন কোন বিষয়ের প্রচার ও প্রচলন করা, যা ইসলামের পরিপন্থী।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রদানকৃত ফতোয়াসমূহ লিপিবদ্ধ করা এবং ফিকহী বিষয়সমূহ সুবিন্যস্ত করার দায়িত্ব তাঁহার দুই ছেলে যথাক্রমে সালেহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল পালন করেন। এমনকি তাঁর দুই ছেলে ও প্রসিদ্ধ ছাত্রদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রসিদ্ধ ‘হাম্বলী মাযহাব।’

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি বহুবার মক্কায় গমন করেছেন এবং মোট পাঁচবার যথাক্রমে ১৮৭, ১৯১, ১৯৬, ১৯৭ ও ১৯৮ হিজরী সনে হজ পালন করেছেন।

ইন্তেকাল ও দাফন

এই মহান মনীষী বারবার নির্যাতনের শিকার হওয়ায় জীবনের শেষ দিকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি ৭৫ বছর বয়সে ২৪১ হিজরি সনে  ইন্তেকাল করেন। অনেক মানুষ তার জানাজায় অংশ নেয়। জানা যায়, জানাজা নামাজে মানুষের সংখ্যাধিক্য ও তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে সে সময় প্রায় বিশ হাজার ইহুদি, খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করে। তাঁকে বাগদাদের হারবিয়্যা অঞ্চলে শহিদদের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তবে দুঃখজনক যে, ৮ম হিজরিতে টাইগ্রিস নদীর এক প্লাবনে তাহার কবরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

লেখক : তরুণ লেখক ও গবেষক

এমএমএস/জেআইএম