একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার মনিরুজ্জামান কোহিনূর ওরফে মো. মনিরুজ্জামানসহ (৭০) দুই আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। অন্য আসামির নাম আলমগীর তালুকদার (৬৭)।
বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে ধানমন্ডিতে তদন্ত সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক। এটি তদন্ত সংস্থার ৮৭তম প্রতিবেদন।
দুই আসামির মধ্যে এমন একজন আসামি রয়েছেন, যিনি শিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারতের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমে পাকিস্তানে আশ্রয় নেন এবং পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। এরপর পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে জাপান যান। সেখান থেকে কৌশলে ২০০২ সালে বাংলদেশের নাগরিকত্ব নেন।
তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদর বাহিনীর সাথে যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের কারাগারে বন্দি ছিলেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে ২০০২ সালে দেশে ফিরে আসেন।
তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার কো-অর্ডিনেটর এম সানাউল হক জানান, এ মামলায় আসামিরা হলেন, টাঙ্গাইল গোপালপুর উপজেলার বেড়াডাকুরী গ্রামের সবুর মাস্টারের ছেলে রাজাকার কমান্ডার কোহিনূর ওরফে মনিরুজ্জামান কোহিনূর।
অন্যজন গোপালপুর উপজেলার চাতুটিয়ার ছবর আলীর ছেলে রাজাকার আলমগীর ওরফে শা. আ. ম আলমগীর তালুকদার। রাজাকার আলমগীরের রাজনৈতি পরিচয়ে বলা হয়েছে, তিনি জামায়াতের সমর্থক। এই দুই আসামি গত ৩ মার্চ থেকে গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে কোহিনূর রাজাকার সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া ও ভারতীয় তথা যৌথ বাহিনীর অভিযানে টাঙ্গাইল জেলা মুক্ত হয়। টাঙ্গাইল জেলা আলবদর কমান্ডার মনিরুজ্জামান কোহিনূর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে পশ্চাৎপসারণ করে ঢাকায় আশ্রয় নেয়। এর পর ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদর বাহিনীর সাথে যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সে খাঁন সেনাদের সঙ্গে ভারতের জব্বলপুর কারাগারে বন্দি ছিল। শিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয় এবং পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে। পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে সে জাপান যায়। ২০০২ সালে একটি মহলের যোগসাজশে কৌশলে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বাংলাদেশে আসেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে জানা যায় তিনি মুসলিম লীগের সমর্থক।
এর আগে ২০২১ সালের ৩১ মে আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এরপর অনুসন্ধান শেষে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এখন প্রসিকিউশনের কাছে তা দাখিল করা হবে। তার আগে সেটি প্রকাশ করা হলো।
এ দুই আসামির বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে:প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৮ জুন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মুসলিম উদ্দিন মিয়া ওরফে মুসলিম মাস্টারকে রাজাকার কোহিনূর এবং তার সহযোগী রাজাকারেরা নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে মরদেহ গুম করে।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রাজাকার কোহিনূর অন্যান্য রাজাকারসহ পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে নিয়ে মুসলিম মাস্টারের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। একই দিন মুসলিম মাস্টারের শশুড়বাড়ি গিয়ে তার দুই মেয়েকে আর্মিদের হাতে তুলে দিতে বলে। তাদের না পেয়ে ওই বাড়ি থেকে আবুল মনসু মোহাম্মদ মাজহারুল হাসান তালুকদার নামে একজন তুলে নিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর তাকে কাদেরিয়া বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজাকার কোহিনূর ও আলমগীর হানাদার বাহিনীর সহায়তায় শাহীন হাওলাদার, শহীদ দুদু ফকির, শহীদ আমজাত ফকিরদের তাদের বাড়িতেই গুলি করে হত্যা করে এবং মোছা. সমলা বেগমকে উরুতে গুলি করে জখম করে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে যাকে যেখানে পায় গুলি করে। মুক্তিযোদ্ধা মনে করে তারা ৪/৫ নিরস্ত্র লোককে গুলি করে হত্যা করে।
একদিন তারা মাহমুদপুর থেকে পানকাতা গ্রামের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে এবং ২৫/৩০টি বাড়ির মালামাল লুট করে অগ্নিসংযোগ করে।
এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস