সময়ের সঙ্গে দেশের শিক্ষাব্যবস্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকায় সরকারও এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কারিগরি শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে কারিগরি শিক্ষার প্রতি এখনো আগ্রহী নন সাতক্ষীরার বেশিরভাগ অভিভাবক। যে কারণে জেলার মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় অংশই কারিগরি শিক্ষায় আসছে না।
সাতক্ষীরা ভোকেশনাল স্কুল, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টিটিসিসহ কয়েকটি কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রের ছাত্র, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, জেলার কারিগরি শিক্ষা নিয়ে এখনো রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া সরকারি পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল স্কুলে আসন সংকট, জনবল, প্রয়োজনীয় উপকরণ, মেশিনারিজসহ অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকায় মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার কারিগরি শিক্ষার্থীরা।
সাতক্ষীরা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম, ২০২০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। এরপর সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে থেমে যাচ্ছেন বারবার। কিন্তু থেমে নেই তার বয়স। লেখাপড়ার বাইরে অন্য কোনো কাজও শেখা নেই তার। দরিদ্র বাবার সংসারে বেকার রাকিবুল হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেকে পরিবারে বোঝা ভাবতে শুরু করেছেন। রাকিবুলের মতো এমন অনেকেই আছেন যারা অনার্স- মাস্টার্স শেষ করে বেকার বসে আছেন।
তবে উল্টো গল্প দেশের একটি স্বনামধন্য মোবাইলফোন কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত সাতক্ষীরা টেকনিক্যাল স্কুলের কম্পিউটার বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আবিদ হাসানের। কথা হলে তিনি বলেন, মা-বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু নিয়তিতে হয়তো সেটা লেখা ছিল না। স্কুলে আমি দুর্বল ছাত্র ছিলাম। দুইবার পরীক্ষা দিলেও সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়নি। পরে পরিবারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি কারিগরি স্কুলে ভর্তি হই। এসএসসি পাসের পর একই বিষয়ে ডিপ্লোমা ও বিএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তবে সেখান থেকে পাস করার পর আমাকে বসে থাকতে হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই একটি কোম্পানিতে চাকরি হয় আমার। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর ভালো বেতনে মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করছি।
তিনি বলেন, দক্ষ কর্মীদের বিদেশে চাকরির অনেক সুযোগ রয়েছে। আমি চেষ্টা করছি, সুযোগ পেলেই চলে যাব। কিন্তু কষ্টের বিষয় হচ্ছে, অনার্স-মাস্টার্স পাস করা আমার অনেক বন্ধু এখনো বেকার। কারিগরি শিক্ষা নিয়েছিলাম বলেই আমি অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি।
আবিদ আরও বলেন, কারিগরি খাতে দেশে-বিদেশে দক্ষ জনবলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহী করাটা এই বেকারত্ব থেকে নতুন প্রজন্মকে মুক্তির পথ হতে পারে। তেমনি বাড়তে পারে দক্ষ জনশক্তিও। কিন্তু সাতক্ষীরায় অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র না থাকার কারণে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সাজেদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কারিগরি শিক্ষায় অভিভাবকরা মোটেও আগ্রহী নন। এর প্রধান কারণ এর সামাজিক মান নিয়ে। চার বছরের কোর্স শেষে ডিপ্লোমা পাস করার পর এ ডিগ্রিকে এইচএসসির সমমান ধরা হয়। যে কারণে অনেকের ধারণা, এ যোগ্যতা দিয়ে বেশিদূর আগানো যাবে না। যার ফলে উৎসাহের জায়গাটা কমে আসে। এছাড়া সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা দেওয়া হয়। যোগ্যতা ও পদমর্যাদার তারতম্য এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনীহার একটা বড় কারণ।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় সম্ভাবনা থাকলেও এখনো কোনো বড় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। এজন্য কারিগরি শিক্ষা নেওয়া বেকার যুবকদের কাজের সুযোগ হচ্ছে না। এছাড়া যারা খণ্ডকালীন কোর্স করেন, আর্থিক সংকটের কারণে তারাও সেটি সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না। এসব কারণে অনেকে কারিগরি শিক্ষা নিতে চান না।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শাল্লে গ্রামের বাসিন্দা ও সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান জাগো নিউজকে বললো, আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার পর কারিগরি শিক্ষা নিতে সাতক্ষীরা টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হই। এখান থেকে আমি সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায় নিজেকে একজন দক্ষ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে পারব।
সে আরও বলে, গ্রাম থেকে অনেকে শহরে এসে পড়াশোনা করতে পারে না। তাছাড়া অভিভাবকরাও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী নয়।
সাতক্ষীরার একটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হৃদয় মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, এখনো দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কারিগরি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। শহরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব, সিট স্বল্পতা, যথাযথ ইনস্ট্রুমেন্ট না থাকাসহ রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। তবে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আবাসিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখান থেকে অনেকেই বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা নিতে পারছেন। তবে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। তিনি আরও বলেন, বেকারদের কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
সাতক্ষীরার একটি বেসরকারি কলেজের সাবেক সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল মাজেদ জাগো নিউজকে বলেন, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আত্ম-কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে। তবে এখনো অভিভাবকদের মাঝে কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে অনীহা আছে।
তিনি বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে অধিকাংশ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রশাসনের উচ্চ পদে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে দেখতে চান। সেই প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত সাতক্ষীরার অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী। এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিলে আমরা উন্নত জাতি গঠন করতে পারব।
সাতক্ষীরা টেকনিক্যাল স্কুলের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সাতক্ষীরা সরকারি ভোকেশনাল স্কুলে বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ রয়েছে। মোট শিক্ষার্থী ৮০০ জন। এখানে কম্পিউটার, ফার্ম মেশিনারিজ, ইলেকট্রনিকস ও আরএসি ট্রেড চালু আছে। এছাড়া খণ্ডকালীন ৯০ দিনের ড্রাইভিং কোর্স করানো হয়।
তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষার মান বাড়াতে সাতক্ষীরা জেলার দুই উপজেলা আরও দুটি টেকনিক্যাল স্কুল চালু হয়েছে। একটি শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ অপরটি কালিগঞ্জে।
সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. আবদুল কুদ্দুস সরদার জাগো নিউজকে বলেন, কারিগরি খাতে কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। দিন দিন কারিগরি শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজার বড় হচ্ছে। তবে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার তেমন কোনো প্রচার -প্রচারণা হয় না।
তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে। প্রথম দিকে আমরা ছাত্রছাত্রী খুঁজে পেতাম না, অথচ সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ১ হাজার ৪০৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এখানে চাহিদার চেয়ে সিট সংখ্যা কম। অনেকে ভর্তি হতে আগ্রহী, আমরা তাদের সুযোগ দিতে পারছি না। এছাড়া দক্ষ জনবল ও শিক্ষকের সংকট রয়েছে।
অধ্যক্ষ আবদুল কুদ্দুস জানান, সাতক্ষীরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বর্তমানে সিভিল, ইলেকট্রনিক, কম্পিউটার, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (আরএসি), এনভায়রনমেন্টাল এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগ চালু আছে।
এমআরআর/এএসএম