ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের এক বছর পার হলেও নিহতদের পরিবার পায়নি কোনো ক্ষতিপূরণ। পায়নি কোনো প্রকার সরকারি সহায়তাও। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা। যদিও জেলা প্রশাসন বলছে, সরকারি সহায়তার জন্য নিহতদের তালিকা নৌমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগির তাদের সহায়তা প্রদান করা হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৯ যাত্রী আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তখন ২৬ জনের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তবে শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়ায় ২৩ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। ওই সব মরদেহের নমুনা সংরক্ষণ করে বরগুনা সদর উপজেলার পোটকাখালী গণকবরে অজ্ঞাত পরিচয় হিসেবে ২১টি কবরে দাফন করা হয়। এরপর ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিএনএ পরীক্ষক রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে একটি টিম ২৩ মরদেহের পরিচয় শনাক্তের জন্য ৪৮ জন স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেন। যার মধ্যে গত জুলাই মাসে ১৪ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়।
ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে যাদের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে তারা হলেন- বরগুনা সদর উপজেলার কুমারখালী গ্রামের হনুফা আক্তার(১৯), ঢলুয়া গ্রামের মোতাচ্ছিম(১১), মাইঠা চৌমুহনী গ্রামের মো. ইদ্রিস খান(৫২), বড় লবণগোলা গ্রামের আ. হাকিম শরীফ (৪৫), তার স্ত্রী মোসা. পাখি বেগম(৪৫) ও ১৫ মাসের শিশু সন্তান মো. নসরুল্লাহ, খাজুরা ঢলুয়া গ্রামের মো. মহিন(৩৭), মোল্লার হোরা গ্রামের মোসা. সুমাইয়া আক্তার মিম(১৫), রায়ভোগ গ্রমের মো. আব্দুল্লাহ(৪) ও তার বোন মোসা. আছিয়া(১), বেতাগী উপজেলার মোকামিয়া গ্রামের মো. আরিফুর রহমান (৩৬) ও তার মেয়ে তাহসিনা আক্তার আবিদা(৪), দক্ষিণ করুনা গ্রামের রানা বেগম(৩২) ও তার মেয়ে রুশ্মি আক্তার লিমা(১২)।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরগুনা সদর উপজেলার লবণগোলা গ্রামের হাকিম শরীফ(৪৫), তার স্ত্রী মোসা. পাখি বেগম(৩২) ও তাদের ছেলে নজরুল্লাহ(১) ওই দুর্ঘটনায় নিহত হন। ওই পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নিহত হাকিম শরীফ। তার মৃত্যুতে তিন নাতি-নাতনি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাকিম শরীফের সতুরোর্ধ্ব মা এরাতন বিবি। তিনি পাননি কোনো প্রকার সরকারি সহায়তা। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারদেনা করে তিন নাতি-নাতনি নিয়ে কখনো অর্ধাহার আবার কখনো অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
এরাতন বিবি জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার সময় লঞ্চে আগুন লেগে আমার ছেলে, ছেলের বউ ও দেড় বছরের নাতি মারা গেছে। আমাকে আয় রোজগার করে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই। তিন নাতি-নাতনি হাফসা, সুমাইয়া ও ফজলুল করিমকে নিয়ে কখনো খেয়ে আবার কখনো না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। সরকার কোনো প্রকার সহায়তা দেয়নি।
একই অবস্থা বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া এলাকার নিহত মো. মহিনের(৩৭) পরিবারের। এই পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মহিম। উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুতে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন ৭৫ বছর বয়সী বাবা মো. আব্দুল হক। মানুষের কাছে সহযোগিতা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তারা।
মহিমের বাবা মো. আব্দুল হক বলেন, আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলের মৃত্যুতে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। আমি অসুস্থ মানুষ, কোনো প্রকার কাজ করতে পারি না। সরকারও কোনো প্রকার সহায়তা করেনি। সরকার যদি সহায়তা না করে তাহলে না খেয়ে মারা যেতে হবে।
নিহত মহিমের স্ত্রী লিপি বেগম বলেন, আমার বৃদ্ধ শ্বশুর, শাশুড়ি ও দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আমার স্বামী মারা যাওয়ার এক বছরের মধ্যেও সরকার কোনো সহায়তা দেয়নি। আমার স্বামীকে পুড়িয়ে মারা লঞ্চ মালিকের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।ক্ষতিপূরণ না পেলে আমাদেরকে না খেয়ে মরতে হবে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, নিহতদের তালিকা করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশা করছি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিহতদের পরিবারকে সহায়তা প্রদান করতে পারব।
এফএ/এএসএম