এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত ‘তেলবাজ’(২০১৬) উপন্যাসে হাস্যরস সৃষ্টির পুরো কৃতিত্ব কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের। সিরিয়াস উপন্যাস রচনার পাশাপাশি পঁচিশ বছরের সাহিত্যচর্চার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে হাস্য ও রম্য রচনায় তিনি পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। হাস্যরসাত্মক উপন্যাস লেখা সহজ ব্যাপার নয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের ১৩৬ পৃষ্ঠার দীর্ঘ পরিসরে কাহিনির মূল রস হিসেবে হাস্যরসকে স্থান দেওয়ার প্রয়াস বাংলা উপন্যাসে খুব কমই দেখা যায়। বাংলায় মজার হাসি, তামাশা, পরিহাস, উপহাস, বিদ্রুপ প্রভৃতি শিরোনামে বৈচিত্র্যময় সাহিত্য আছে। প্রহসন রচনার যুগ ছিল একসময়। আবার কৌতুক রচয়িতার রসের কারবারিতে আমরা মুগ্ধ হয়েছি বারবার। জীবনের কথা বলতে গিয়ে মোস্তফা কামাল জীবনরসিক রসস্রষ্টা হিসেবে সরস কৌতুক আর গভীর সহানুভূতিকেই শেষ পর্যন্ত মুখ্য করে তুলেছেন ‘তেলবাজ’ উপন্যাসে। সংগতির অভাব বা অসংগতির কারণেই হাসির উদ্ভব হয়। নিয়মের মাঝে বেনিয়ম যখন সব এলোমেলো করে দেয় তখন তা কৌতুকবোধ জাগায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কৌতুক আমাদের চিত্তের উত্তেজনার কারণ, এবং চিত্তের অনতিপ্রবল উত্তেজনা আমাদের পক্ষে সুখদায়ক।’ এই সুখদায়ক রসের পরিচয় আছে ‘তেলবাজ’-এর তেলায়েত তরফদার চরিত্র রূপায়ণের মধ্যে।এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তেলায়েত তরফদার কেবল নয় তার অফিসের বস আবদুল করিম পাটোয়ারিসহ আরো যেসব মানুষের আচরণে আমাদের সমাজের বিচিত্র চিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে তা যেমন হাস্যোদ্দীপক তেমনি শিক্ষণীয়। মোস্তফা কামাল এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন শহরের মেধাহীন মানুষ কী করে উন্নতির শিখরে পৌঁছায় কেবল তোষামোদ এবং তেলবাজি করে। পরিশ্রম ও মেধা ছাড়াই ওইসব মানুষ সহায়-সম্পত্তির মালিক হয়, পরিণত হয় ক্ষমতাবানদের নিকটজন। কাহিনিতে দেখা যায় তেলায়েত শুধু তেলমারার কৌগশলটাই ভালো করে রপ্ত করেছিলেন। সেটাই তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি। তরতর করে সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ঔপন্যাসিক এর পাশাপাশি নাটকীয় কিছু ঘটনায় নাগরিক জীবনের নানা প্রতারণার চিত্র অঙ্কন করেছেন। যেমন, অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেয়া, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের পুরস্কারকে মিডিয়ার প্রচারণায় গুরুত্ববহ করে তোলা। টিভিতে প্রচারিত নাটকের কাহিনি অন্যের লেখা হলেও নিজের বলে বিলবোর্ডে পর্যন্ত প্রচার করা প্রভৃতি ঘটনার বিবরণও দিয়েছেন লেখক। সমাজের সর্বত্র অযোগ্য মানুষের বিস্ময়কর উত্থানে লেখক যেমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তেমনি তেলবাজ চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচন করে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন।তেলায়েত তরফদারের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার চিত্রেও তেলবাজের নানা প্রসঙ্গ কাহিনিতে স্বতন্ত্র মাত্রা যুক্ত করেছে। দিলরুবা যে মানসিক ডাক্তারের কাছে উপস্থিত হয় সেখানেও তেলের মহিমা ঘটনাচক্রে প্রকাশ পায়। তার পুত্র তাহমিদ যে অফিসে চাকরি করে সেখানেও তার বসের জন্য তেলবাজির কাজ করতে হয়। অন্যদিকে যে সচিব কবিতা লেখেন তিনি তেলায়েতের কণ্ঠে তার কবিতা শুনে ফাইলে স্বাক্ষর করে দেন। একটি টিভি চ্যানেলের মালিক সারোয়ার মিয়ার নিজের লেখা না হলেও ‘কাকামিয়া’ নাটক তার নামে প্রচারিত হয়। তাহমিদ বিলবোর্ডে তার প্রচার দেখে মুচকি হাসে। অন্যদিকে কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সিরাজুল হকের জন্মদিনে সারোয়ার মিয়ার টিভি যেভাবে অনুষ্ঠান প্রচার করে তাতে মিডিয়ার তেলবাজিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে ভুয়া পিএইচডিধারী, যশ এবং খ্যাতির অভিলাষী ভুয়া ব্যক্তিবর্গের নানা আচরণ নিঃস্বার্থ কৌতুকরস সৃজন করেছে।মূলত মোস্তফা কামাল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অসংগত আচরণের অসাধারণ কিছু চিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। আমরা প্রতিদিন এমন কত অসংগত আচরণ করি, যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। হাস্যরসিক লেখক মোস্তফা কামাল দু’এক কথায় আমাদের সেই অসংগতি ধরিয়ে দিয়েছেন। ‘তেলবাজ’ উপন্যাসের সার্থকতা এখানেই। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে এটি প্রকাশ করেছে অনন্যা। মূল্য : ২২৫ টাকা। বইটির বহুল প্রচার কাম্য।এইচআর/পিআর