স্বাস্থ্য

চট্টগ্রাম মেডিকেলে একজন মেরিনারের বেঁচে ওঠার গল্প

রাজধানীর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও বেসরকারি অভিজাত হাসপাতালগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চট্টগ্রামেও চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। সেবা দিয়ে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা পাচ্ছেন তারা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

জীবন হারাতে বসা মানুষ ফিরে পাচ্ছেন স্বাভাবিক জীবন। সুস্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন পরিবারের কাছে, নতুন জীবনের স্বাদ নিয়ে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এস এম নোমান খালেদ চৌধুরী ফেসবুকে লিখেছেন এমনই একটি জীবন বাঁচানোর গল্প। তিনি ওই পোস্টের শেষাংশে লেখেন, ‘Life is so beautiful! মৃত্যুর পূর্বে মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ মৃত নয়!’

এ নিয়ে জানতে চাইলে ডা. নোমান খালেদ জাগো নিউজকে বলেন, গত তিন মাস আগে এই অপারেশন করা হয়।

পোস্টে তিনি লেখেন, শুভ নববর্ষ ২০২৩। নববর্ষের এই অনিন্দ্য সময়ে একটি সুন্দর অনুভূতির উপস্থাপন করছি। মৃত্যুর পূর্বে মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ মৃত নয়। রাত ১০ টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান টেলিফোনে জানালেন চট্টগ্রামের সমূদ্র তীরবর্তী নেভাল এরিয়ায় একজন মেরিনার গুরুতর আহত হয়ে শহরের পার্ক ভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হয়েছে, সংকটাপন্ন অবস্থা। কিছু করা যায় কি না... সংশ্লিষ্ট আইসিইউ এর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন, আহত ব্যক্তির জ্ঞানের মাত্রা GCS 5/6.. আমি রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে নিয়ে আসার জন্য বলি।

সেই অনুযায়ী পার্ক ভিউ হাসপাতালের আইসিইউ চিকিৎসকদের যথোপযুক্ত তত্ত্বাবধানে রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি অপারেশন কক্ষে আনা হয় গভীর রাতে। এর মধ্যেই রোগীর অবস্থার আরও অবনতি হয়। জ্ঞানের মাত্রা GCS 4/5... উপস্থিত অনেকে (চিকিৎসকসহ) রোগীর মুমূর্ষু অবস্থা। সে অবস্থায় আমি অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি চির আশাবাদী ও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা মানুষ। রোগীর অবস্থার জটিলতা এবং অপারেশন ফলাফল রোগীর স্বজনদের ব্যাখ্যা করে অপারেশন করার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানাই।

এরপর রাতব্যাপী আমি আমার সহকর্মী, ছাত্র রেসিডেন্টদের নিয়ে অপারেশন করি এবং রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। অপারেশনকালে রোগীর মাথার হাড় বাইরে রাখি; এই উদ্দেশ্যে যদি সুযোগ হয় তা পরে প্রতিস্থাপন করা হবে।

২ সপ্তাহ পর রোগীর জ্ঞান ফেরে। আইসিইউ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক হারুনের নেতৃত্বে তাদের চিকিৎসায় রোগী ৩ সপ্তাহ পর হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ বেডে স্থানান্তর হয়। পরবর্তী সময়ে আরও উন্নতি লাভ করে রোগীকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়।

এরপর রোগী আমাদের ফলোআপে থাকে। পরবর্তী সময়ে তার মস্তিষ্কের হাড় আরেকটি অপারেশন করে প্রতিস্থাপন করি। বর্তমানে রোগী স্বাভাবিক জীবন উপভোগ করছে।

ডা. এস এম নোমান খালেদ জানান, চমেক হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে ২০২২ সালে প্রায় ৩০ জন রোগীকে এ ধরনের অপারেশন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, মৃত্যুর পূর্বে মুমূর্ষু অবস্থায় কোনো মানুষই মৃত নয়। আমাদের চিকিৎসকসহ সবাইকে মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষকে সাহসের সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে পাশে দাঁড়িয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সঠিক সিদ্ধান্ত যথোপযুক্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কর্তব্য পালন করা, ফলাফল দেওয়ার মালিক আল্লাহ।

‘সততা, সাহস ও যোগ্যতার সঙ্গে কর্তব্য পালন সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত বলে আমি মনে করি। এটি দেশপ্রেম প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। আমাদের প্রজন্ম, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাইনি, আমরা দেশের কল্যাণে মানুষের সেবায় সততার সঙ্গে কাজ করে, মুক্তিযুদ্ধে সুযোগ না পাওয়ার দুঃখটা ঘোচাতে পারি। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন করা পতাকা আমাদের হাতে। এই পতাকা এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।’

এখানে সরকারেরও দায়িত্ব আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যথাযোগ্য ব্যক্তিদের যথাযোগ্য জায়গায় পদায়ন করতে হবে। সেভাবে কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমি শিগগির নিউরো সার্জারি বিভাগ থেকে অবসরকালীন বিদায় নিচ্ছি। আমি চাই, এখানেও সরকার যথাযোগ্য ব্যক্তিদের পদায়ন করুক। আমলাতন্ত্রের বর্তমান প্রচলিত মানসিকতায়, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের আশা সুদূরপরাহত। তারা (আমলা) বিষয়বস্তু সম্পর্কে যেহেতু অভিজ্ঞ নন, সেহেতু তারা বিষয়বস্তুর আলোকে সিদ্ধান্ত নেন না। তারা প্রচলিত বিধিবিধান মতে সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি বলেন, নিউরো সার্জারি একটি বিশেষ বিষয়। অনেকটা বিমান চালানোর মতো। কিন্তু সড়কে গাড়ি চালানোর টেকনোলজি এবং দক্ষতা যদি বিমান চালানোর দক্ষতার সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে বিমান চালানোর উৎকর্ষতার সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নিউরো সার্জারির মতো বিশেষ বিষয়কে গুলিয়ে ফেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া, সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা আমাদের কোনো কার্যকর ফল দেবে না।

এর আগে ২০২১ সালে সারাদেশে আলোচিত ‘হাড় নেই চাপ দেবেন না’ ঘটনার সেই মুমূর্ষু মাহাদি জে আকিব চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে অপােরেশনের মাধ্যমে সুস্থ হন। মুমুর্ষ মাহাদিকে ঘটনার আড়াই ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করা না গেলে বাঁচানো দুরূহ হয়ে যেত বলে তখন চিকিৎসকরা মত দিয়েছিলেন। এই মেরিনারের মতোই মাহাদিকে কয়েক দফায় অপারেশন করা হয়। এখন মাহাদি প্রায় সুস্থ।

ইকবাল হোসেন/এমএইচআর/জেআইএম