প্রশাসনের অবহেলা ও নজরদারির অভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ায় শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে ছোট বড় পাঁচ শতাধিক চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়টি অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে উঠবে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। বিশ্ববিদ্যালয়কে পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহার, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, বহিরাগত ও অপরাধীদের অবাধ যাতায়াত, যত্রতত্র দোকান-পাট স্থাপন, নিরাপত্তা রক্ষী সংকট ও প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবন ও অফিস কক্ষে ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন এলাকা হতে পানির পাম্পসহ ৫ লক্ষাধিক টাকার যন্ত্রাংশ, ২০১৫ সালের ১ জুলাই ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পাশ থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা মূল্যের বৈদ্যুতিক কেবল, ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর জাবি স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র সাফাত রহমানকে প্রান্তিক ফটক হতে অপহরণ, ১৯ ডিসেম্বর সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক একেএম মহিউদ্দিনের অফিস কক্ষ হতে ল্যাপটপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র, ২১ নভেম্বর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এএসএম আবু দায়েনের বাসায় মোবাইল, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুমের বাসায় কম্পিউটার ও টেলিভিশন চুরির ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় জিডি করা হয়। তারপরেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। এছাড়া জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৪৪ বছরেও কোনো সীমানা প্রাচীর না থাকায় ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে বিভিন্ন অপরাধে জড়িতরা এবং ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ রক্ষায় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালো করতে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের ৫ কোটি টাকার অর্থায়নে জাবির সীমানা প্রাচীরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ৫ই অক্টোবর। গত দুই বছর চার মাসে প্রাচীরের মাত্র ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্শ্ব, রেডিও কলোনি ও গেরুয়া বাজার এলাকায় প্রাচীরের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থ বিবেচনায় রেখে সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্ববর্তী গেরুয়া বাজার ও বিশমাইল এলাকায় দুটি ফটক রাখার অনুমোদন দেয়। কিন্তু কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে, প্রায় ৭টি ফটক উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। ফলে এসব ফটক দিয়ে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতরা অবাধে ক্যাম্পাসে বিচরণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখা সূত্রে জানা যায়, ৬৯৭ একরের ক্যাম্পাসে মাত্র ৯৪ জন গার্ড রয়েছেন। এদের মধ্যে দুইজন প্রক্টর ও ফজিলাতুন্নেসা হলের অধীনে এবং ১০ জন প্যারালাইজডসহ বিভিন্ন রোগে অসুস্থ রয়েছেন। ২০-২৫ জন গার্ড বয়স্ক হওয়ায় তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। তবে গত চারদিনের হিসেবে দেখা যায়, প্রতিদিনই গড়ে ১১ জন গার্ড কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত টহল গাড়িও নষ্ট। তবে গার্ডরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন কিনা সে বিষয়ে কোনো পরিদর্শক কর্মকর্তা না থাকায় গার্ডরা দায়িত্বে অবহেলা করছেন।বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালো না হওয়ায় ছোট বড় ১০টি ফটক দিয়ে বহিরাগতরা ও বিভিন্ন অপকর্মে জড়িতরা নির্বিঘ্নে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বিভিন্ন অপকর্ম করে আবার নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে। তবে পশ্চিম পার্শ্বে অবৈধভাবে একাধিক ফটক রাখায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে নিরাপত্তা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. জেফরুল হাসান চৌধুরী বলেন, ছাত্রসংশ্লিষ্ট বিষয়টি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে না থাকলেও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাও ছাত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বও আমাদের উপর চাপিয়ে দেন। ফলে আমাদের বিরম্বনা ও বাজে আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। ক্যাম্পাসের কোনো এক জায়গায় মারামারি বা কোনো ঝামেলা হলে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যা আমাকে খোঁজ নিতে বলে। অথচ খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব তাদের। এর ফলে প্রশাসন থেকে আমাদের সবসময় চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সের যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, অনুমোদনহীন যত্রতত্র দোকান-পাট স্থাপনের ফলেও নিরাপত্তা ও শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এদিকে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিকনিক স্পট হিসেবেও ভাড়া দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বেপোরোয়াভাবে গাড়ি চালানো এবং যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে বহিরাগতদের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকদের মারামারির ঘটনাও ঘটছে। তবে দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষক মঞ্চের মুখপাত্র সহযোগী অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো অ্যায়াজমালি জায়গা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পাসে অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি ও জনসাধারণের অনধিকার প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘পুরো প্রাচীর নির্মাণ কাজ শেষ হলে দুটি গেইট রেখে বাকি ফটক বন্ধ করে দেওয়া হবে। যত্রযত্র গাড়ি পার্কিং না করার বিষয়ে বিভাগগুলোর সঙ্গে কথা বলা হবে। হাফিজুর রহমান/একে/আরআইপি