ক খ হাসান
Advertisement
এবারের শীতটা যেন যেতেই চাচ্ছে না। যদিও বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী মাঘ মাস প্রায় শেষই বলা চলে। তপু ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে মাঘের শেষ দুই সপ্তাহ বা ইংরেজী পঞ্জিকায় ফেব্রুয়ারি এলেই সমগ্র দেশ উঠে পড়ে লাগে ‘বাংলা মাতৃভাষা দিবস’ বা ইদানিংকালের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস’ পালনে কে কতটা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে তা জনসম্মুখে প্রমাণ করতে।
এবারের শীতের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি তরুণ যুবাদের পাঞ্জাবী আর তরুণীদের শাড়ি পরিধানে কেন যে বেরসিকের মতো আচরণ করছে কে জানে! তবুও যথা সময়ে ৮ ফাল্গুন বা একুশে ফেব্রুয়ারি জাতির জীবনে দিনক্ষণ মেপে ফের উপস্থিত হলো। দিনের প্রথম প্রহর থেকে চলছে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজারো নারী-পুরুষের আসা-যাওয়া আর ৫২র ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পুষ্প অর্পণ।
যদিও তপু সবসময়েই চেষ্টা করে শহীদ মিনারে প্রথম প্রহরে যেতে কিন্তু রিমার সঙ্গে সম্পর্কের পর থেকে ওর সময় সূচিতে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ও রিমার সাথী হয়ে সূর্য উদয়ের পরপরই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে থাকে। আজ শহীদ মিনারের কার্যক্রম শেষে রিমা বললো-
Advertisement
‘তপু, যদি তোমার হাতে কোনো কাজ না থাকে তবে চল না নদীর ধার দিয়ে ফাগুনের এই শিশির ভেজা ঘাসে একটু হাঁটি?’
এর আগে তপু কখনই রিমার সঙ্গে সাত সকালে হাঁটার সুযোগ পেয়েছে কিনা মনে করতে পারলো না। আর তাই এ সুযোগ সে সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিয়ে বললো-
‘আরে কি যে বলো? আমার সময়ের কোনো অভাব নেই। তবে আজ আমি মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি- তাই প্রাতঃভ্রমণ শেষে আমাকে কিন্তু ক্যান্টিনে নাস্তা করাতে হবে।’
ওরা দু’জনে নিঃশব্দে হেঁটে চলেছে। এরই মাঝে রিমা বললো-
Advertisement
‘তপু, আজ দেখছি তুমি খুবই চুপচাপ। কিছু কি ভাবছ?’
রিমার প্রশ্নে মনে হলো তপু যেন ঋষির ধ্যান থেকে উঠে এলো। ও বললো-
‘জান, আজ আমার মনে পড়ছে আমার বড় চাচা যিনি একজন ভাষা সৈনিকও ছিলেন তার কথা। আমার ছেলেবেলায় উনার সঙ্গে প্রতিটি ভাষা দিবসে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করার পর ঠিক আজকের মতোই আমরা দু’জনা এমনই এই নদীর তীর ধরে হাঁটতাম।’
‘উনার মৃত্যুর শেষ কয়েক বছর আমায় প্রায়ই বলতেন আমরা শুধু ভাষা দিবসের মাস এলেই বাংলা বাংলা করে মুখে ফেনা তুলি। অথচ আমরা আজও কুদরত-ই-খুদা কমিশন-এর ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট-এর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা চালু করতে পারিনি। আরও পারিনি ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগ করতে।’
‘তোমার বড় চাচাতো দেখছি সত্য কথাই বলতেন। তবে তুমি কি জান কুদরত-ই-খুদা কমিশন উনাদের রিপোর্ট বাংলার পরিবর্তে ইংরেজীতে লিখেছিলেন?’
‘আমার এটা জানা ছিল না। কিন্তু তুমি কি জান কেন রিপোর্টটি বাংলায় লেখা হয়নি?’
‘আমি জানি না। তবে আমি মনে করি রিপোর্টটি অবশ্যই ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলায় লেখা হলে ভালো হতো। কারণ এতে করে কমিশনের বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান প্রকাশ পেত।’
‘তবে যে ভাষাতেই রিপোর্ট লেখা হোক না কেন এটা তো আমাদের মানতে হবে যে মাতৃ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।’
‘আমি তোমার সঙ্গে একমত। কিন্তু ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে তোমার বড় চাচা বোধ হয়... আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হবে। এই ধারা মোতাবেক কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্যকোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ - এই বিষয়টার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করতেন, তোমার কি মনে হয়?’
‘আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু আমার চাচা আজও জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন নিম্ন আদালতে ব্যাপকভাবে বাংলা ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু কি তাই, ইদানিংকালে উচ্চ আদালত একটি আলাদা শাখাও তৈরি করেছে যার প্রধান কাজ হলো বাংলা ভাষায় রায় লেখার পূর্ণ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
এছাড়াও তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর সফটওয়্যার ‘আমার বাংলা’ প্রবর্তন করেছে যেটা দিয়ে ইংরেজীতে লেখা রায় বাংলায় ভাষান্তর করা যাবে যেন করে সর্ব স্তরের মানুষ অতি সহজেই বুঝতে সক্ষম হবে।’
চলবে...
অধ্যাপক ক খ হাসান, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগারি, কানাডা
এমআরএম/জিকেএস