তিন সন্তান ও স্বামী নিয়ে আফরোজা বেগমের কষ্টের সংসার। স্বামী মৎস্যজীবী। থাকেন সাতক্ষীরার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা শ্যামনগরের নীলডুমুরে। সুন্দরবনের পেটের মধ্যের এক গ্রাম। এর পরে আর বসতি নেই বললে চলে। নদী পার হলেই ঘন বন। প্রকৃতির পাশাপাশি এখানকার হাজারো মানুষের মতো আফরোজাকেও লড়াই করতে হয় সুপেয় পানির জন্য। গোসল বা রান্নার বিশুদ্ধ পানি সেখানে বিলাসিতা! লবণ পানির বিষে ডায়রিয়া, চুলকানির মতো রোগ তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী। উপায়ন্তর না দেখে সুপেয় পানির জন্য এখন পাড়ি দেন কয়েক কিলোমিটার। তাকে সুপেয় পানির বিশুদ্ধ উৎসের এই আশার আলো দেখিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রবাহ’।
Advertisement
আরও পড়ুন>> সমুদ্র উপকূলে সুপেয় পানির হাহাকার
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উপকূলবর্তী জেলাসমূহ বিশেষ করে সাতক্ষীরায় নিরাপদ খাওয়ার পানির ব্যাপক সংকট চলছে বহু বছর ধরেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ জেলাটি প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে লবণাক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে মিষ্টি পানির জলাশয়গুলো বিনষ্ট করে। কমায় মিঠা পানির উৎস। আরও প্রবল হয় সংকট। অনেক ক্ষেত্রে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়েও সুপেয় পানি মেলে না। বাধ্য হয়েই পান করতে হয় লবণাক্ত পানি। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় পুকুর ও নলকূপের মতো মিঠা পানির উৎস দিন দিন কমে যাচ্ছে। মানুষ বাধ্য হচ্ছে দূষিত পানি পান করতে। ফলে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিস, চর্মরোগ ও ঘায়ের মতো রোগ বাড়ছে।
সরেজমিনে সাতক্ষীরা ঘুরে জানা যায়, সরকারকে সহায়তার জন্য বেসরকারি খাতের নিরাপদ খাওয়ার পানির প্রকল্প ‘প্রবাহ’ সাতক্ষীরার লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকার মানুষের জন্য কাজ করছে। নামমাত্র মূল্যে এ প্রকল্পের পরিশোধন প্ল্যান্ট থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পারছেন স্থানীয়রা। প্রকল্পের আওতায় সাতক্ষীরার আশাশুনি, নলতা ও শ্যামনগর উপজেলায় আধুনিক রিভার্স অসমোসিস প্রযুক্তির মোট চারটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। নিরাপদ খাবার পানির জন্য কমে এসেছে তাদের দৈনিক ব্যয়। রান্নার মতো গৃহস্থালির কাজের জন্যও এ পানি ব্যবহার হচ্ছে। এতে পানিবাহিত রোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে অনেক পরিবার।
Advertisement
আরও পড়ুন>> খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট, নিরসনে একাধিক প্রকল্প
স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেড়েছে। শুধু খাবার জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্ল্যান্টগুলো থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। তবে রান্না ও আনুষঙ্গিক সব কাজেই ব্যবহার হয় লবণাক্ত পানি। এতে প্রতিনিয়ত অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকদের কাছে যেতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
জেলার শ্যামনগর উপজেলার নীলডুমুর এলাকার বাসিন্দা করবী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, যতদিন এই মেশিন বসেছে এখান থেকেই পানি নিচ্ছি। আগে যখন মেশিন ছিল না তখন লবণ পানিই ফিটকিরি দিয়ে খেতাম। ওই পানি তো লোনা লাগতো, খাওয়া যেত না। অনেকের তো ঘা, ডায়রিয়া এসব হয়েছে। এখান (প্রবাহ) থেকে আট লিটারের পট ভরে নেই তিন টাকায়। এই পানি আমরা পরিবারের চারজন দুদিন খেতে পারি। গোসল করি ওই লবণ পানি দিয়েই, অভ্যাস হয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানি দিয়ে রান্নাও করি না, সেটাও এই পানি দিয়েই করি। এই পানির মেশিন বসিয়ে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।
পানি নিতে আসা আরেক স্থানীয় বাসিন্দা নাসিমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, আগে লবণ পানি খেতে হতো, তাতে অনেক কষ্ট হতো। বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি রেখে খেতাম। এখন এটা (প্রবাহ প্ল্যান্ট) হওয়ায় এখান থেকে পানি নেই। এক ড্রাম ১০ টাকা দিয়ে নিতে পারি, যা দিয়ে কয়েকদিন চলে যায়। এই পানি শুধু খাই, আর রান্না, গোসল সব লবণ পানি দিয়েই। এই পানির লাইন হওয়ায় অনেক উপকার হয়েছে। লবণ পানি খেলে ডায়রিয়াসহ অনেক রোগ হয়, এখন সেই সমস্যা নেই।
Advertisement
আরও পড়ুন>> স্থায়ীভাবে এলাকা ছাড়ছে সাতক্ষীরা উপকূলের মানুষ
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিখাতও অনেক উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রশংসনীয়। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একত্রিতভাবে কাজ করতে হবে।
‘প্রবাহ’ থেকে প্রতিদিন মিলছে বিশুদ্ধ পানিবিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলের ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকাল গর্ভপাতের শিকার হন এবং ৩ শতাংশ শিশু মারা যায়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশ্ব পানি দিবসের গুরুত্ব অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি।
জানা যায়, এ সংকট নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এরই মধ্যে এগিয়ে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘প্রবাহ’ স্থানীয়দের পানির সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নিরাপদ পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করে চলেছে। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ১৪ বছরের যাত্রায় ‘প্রবাহ’ সারাদেশে ২২টি জেলায় ১১৭টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। ‘প্রবাহ’ নিরাপদ খাবার পানির প্রকল্প থেকে প্রায় দুই লাখ ৮৩ হাজার মানুষ প্রতিদিন পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার লিটার পানি সংগ্রহ করে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রবাহের পানি বছরে দুবার পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও উপকারভোগীরা যে কোনো সমস্যায় বিনা খরচে কল করে প্রবাহ টিমকে জানাতে পারেন। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলসহ পর্যটন নগর কক্সবাজারের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, সবুজ নগর রাজশাহী ও পাহাড়ি অঞ্চল বান্দরবানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে আসছে ‘প্রবাহ’।
সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবাহের পানির প্ল্যান্টে দূর-দূরান্ত থেকে পানি নিতে আসেন অনেকে। দূরত্ব বেশি হওয়ায় অনেক গ্রামের মানুষ আসতে পারেন না। এক্ষেত্রে প্ল্যান্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে বাড়িগুলোতে সরবরাহ করেন এক শ্রেণির মানুষ। এতে কিছুটা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও সুফল পায় বড় একটি অংশ।
আরও পড়ুন>> চারদিকে এত পানি, তবুও হাহাকার
নদী পার হয়ে দাওরা এলাকা থেকে নৌকা নিয়ে পানি সংগ্রহ করতে আসা সুমন বলেন, আমি আজ ১১ ড্রাম পানি নেবো, এখানে তিন পরিবারের জন্য পানি আছে। এখান (প্ল্যান্ট) থেকে আমি ১০ টাকা ড্রাম হিসাবে পানি কিনি, বাসাবাড়িতে কিছুটা বেশিতে বিক্রি করি যাতায়াত ভাড়ার জন্য। দাওরা থেকে নৌকাসহ আমার খরচ পড়ে আড়াইশ টাকা। এখানে নিজের বাসার জন্যও পানি আছে। আগে যখন এ পানি ছিল না তখন দৃষ্টিনন্দন (সরকারি প্রকল্প) থেকে ঘোলা পানি নিয়ে আসতাম। প্রবাহের পানি এসে আমাদের সুবিধা হয়েছে।
আরেক পানি সরবরাহকারী মিরুজ মিয়া বলেন, অনেকে নদী পার হয়ে পানি নিতে আসেন। যারা আসতে পারেন না তারা আমার কাছ থেকে পানি নেয়, আমি গিয়ে পৌঁছে দেই। আমি জারে করে পানি সরবরাহ করি, আবার ৩০ লিটারের যে ড্রাম আছে সেগুলোতেও পানি নিয়ে মানুষের বাড়ি দেই। এখান থেকে আমি লিটারপ্রতি ৩০ পয়সায় কিনি, বাসায় গিয়ে ৬০ পয়সায় বিক্রি করি। এমনিতে যে জারে করে পানি দেই সেগুলো ১২ টাকা নেই, তবে দূর হলে একটু বেশি নেই। আমি একদিনে এক হাজার লিটার পানি দেই, অনেক সময় একদিনে দুই হাজার লিটারও দেই। ধীরে ধীরে এ প্ল্যান্ট পরিচিত হচ্ছে, তাই এখন অনেক মানুষ নিজে এসেই নিয়ে যাচ্ছে।
যেভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে ‘প্রবাহ’
সম্প্রতি জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ আকাশলীনা ইকো পার্ক ও নীলডুমুর জেলা পরিষদ পুকুরে আলাদা দুটি আধুনিক প্রযুক্তির সুপেয় পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে প্রবাহ। প্রতিটি প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার লিটার সুপেয় পানি উৎপাদন হচ্ছে।
‘প্রবাহ’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক সমস্যার পরও দুর্গম এলাকায় এ ধরনের প্ল্যান্ট পরিচালনা করছে প্রবাহ। অনেক সময় এখানে বিদ্যুৎ থাকে না। বিদ্যুৎ না থাকলে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন সম্ভব হয় না। নীলডুমুর, দ্বীপ অঞ্চলগুলো এবং সুন্দরবনের ভিতর থেকে যারা নৌকা নিয়ে আসে তাদের জন্য রাস্তার পাশে আলাদা একটি কালেকশন সেন্টার রয়েছে প্রবাহের। তাদের পাইপের মাধ্যমে পানি দেওয়া হয়।
কীভাবে এসব প্ল্যান্টে পানি বিশুদ্ধ করা হয় জানতে চাইলে ‘প্রবাহ’ প্ল্যান্টের ভেন্ডর ও মার্কো মার্কেটিং করপোরেশনের সিইও অপরুপ আইচ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রবাহ’ পানি বিশুদ্ধকরণ একটি প্রকল্প। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানি বিশুদ্ধ করে। আমরা এ যাবৎকালের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করি। এটিকে বলা হয় রিভার্স অসমোসিস (আর.ও) প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে আমরা সারফেস ওয়াটার ও আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারসহ যে কোনো পানিকে বিশুদ্ধ হিসেবে পরিণত করে পানের উপযোগী করে গড়ে তুলি। অন্য প্রযুক্তির সঙ্গে এ প্রযুক্তির পার্থক্য হচ্ছে এটাতে শরীরে যে পরিমাণ মিনারেল দরকার হয় সেই মিনারেলগুলো অটোমেটিক বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে এখানে ইম্পোজ হয়। পানি যেখানকার হোক না কেন সেটা খাল বিল নদী-নালা কিংবা বঙ্গোপসাগরের হলেও খাবারের পানি হিসেবে উপযোগী করা সম্ভব।
তিনি বলেন, পানির মান নির্ধারণ করে মূলত দুটি বিষয়। একটি টোটাল ডিজলভড সলিড (টিডিএস) আরেকটি হলো পিএইচ। বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী টিডিএসের মান থাকতে হবে এক হাজারের মধ্যে। আর ডাব্লিউএইচওর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী টিডিএসের মান থাকতে হবে ৫০ পিপিএমের মধ্যে। এছাড়াও পিএইচের মাত্রা ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ থাকতে হয়। ‘প্রবাহ’ পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টে পানির মান নিয়ন্ত্রণে মনিটর সেট করে দিয়েছি। সেই মনিটরে পানির টিডিএস ও পিএইচ দেখা যায়। আমাদের এ প্ল্যান্টের পানিতে টিডিএস আছে ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে।
জানতে চাইলে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, শ্যামনগর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে লবণ পানির প্রাধান্য রয়েছে। সে কারণে বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রাপ্যতা তুলনামূলক কম। সরকারের পক্ষ থেকে পানির ট্যাংক বিতরণ এবং তাতে যাতে পানি সংরক্ষণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও খাল যেগুলো ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো খনন করা হচ্ছে। মানুষকে সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, এনজিও এবং প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে।
‘সরকারি যে পুকুরগুলো আছে সেগুলোতে পিএসএফ (‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টার’) বসানো হয়। এছাড়াও কৃষিকাজের সুবিধার্থে বড় বড় খাল খনন করা হয়, তাতে যেন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়। যেখানে স্বাদু পানির স্তর রয়েছে সেখানে নলকূপ বিতরণ করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, যেহেতু প্রত্যন্ত অঞ্চল, এখানে যত বেশি বেসরকারি বিকল্প স্বাদু পানির উৎস করা যাবে আমরা সবাই সেগুলোকে ওয়েলকাম জানাবো। আমরা আরও বেশি বেশি চাই এগুলো হোক। আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি পানি সংরক্ষণাগার অর্থাৎ, বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণের পুকুর করতে চাচ্ছি। এটি পরিকল্পনায় রয়েছে। সরকারি যে পুকুর বা জলাশয় রয়েছে এবং জেলা প্রশাসকের যে খাসজমি সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে ওয়ার্ড পর্যায়ে যাতে একটি করে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি সংরক্ষণাগার করা যায় সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইএইচআর/এএসএ/এমএস