মতামত

আসল বাঘের সামনে ধোনিরা

কথায় বলে, রক্তের স্বাদ পাওয়ার পরই কেবল বাঘ হয়ে ওঠে আসল বাঘ। আজ শিরোপার লড়াইয়ে নামার আগে এই প্রবাদটি খুবই খাটে মাশরাফি বিন মর্তুজাদের বেলায়। এবারের এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচের লড়াইটা ছিল এক নম্বরের সঙ্গে সঙ্গে দশ নম্বরের। তখনও শিকারী বাঘ হয়ে হয়ে ওঠেনি টাইগাররা। আপাত নিরীহ দর্শন বাঘকে খাঁচাবন্দী করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি টি২০ ক্রিকেটে এক নম্বরের লেবেল আঁটা মাহন্দ্রে সিং ধোনি বাহিনির। শিরোপার লড়াইয়ে নামার আগে অংকগুলো সব একইরকম আছে। ভারত এক নম্বর, বাংলাদেশ দশ নম্বর। সেই একই মাঠ, সেই প্লেয়ার। বরঞ্চ দলের সেরা পেসার স্লোয়ার-কাটার স্পেশালিস্ট মুস্তাফিজুর নাই এই ঐতিহাসিক মিশনে। তবে একটা জায়গায় পার্থক্যটা অনেক বেশি। ফাইনালের আগে টাইগাররা আর নিরীহ দর্শন নাই, পাকা শিকারী, এক কথায় আসল বাঘ।ফাইনালকে সামনে রেখে বাস্তবতার নিরিখেই কথা বলেছেন মাশরাফি-ধোনি।  বাংলাদেশ অধিনায়কের ভাষায়-‘ফাইনালে ফেভারিট হিসাবেই মাঠে নামবে ভারত।’ ভারত অধিনায়ক বলেছেন- ‘বাংলাদেশ ভালো খেলছে, দাপুটে ক্রিকেট খেলছে। ফাইনালে জিততে হলে আমাদের আরেকটি দারুণ পারফরম্যান্স দেখাতে হবে।’ ধোনির কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে উদ্বোধনী ম্যাচের মত শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি  দশ নম্বরের সঙ্গে এক নম্বরের দ্বৈরথ নয় । খেলাটি চাপের মুখে একের পর এক বড় বাধা পেরুনো দলের বিপক্ষে। শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের মত প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে শিকারে পরিণত করা টাইগারদের শেকল পরাতে  নিজেদের সেরাটা দিতে হবে  সেটাই জানিয়ে দিয়েছেন  ভারত অধিনায়ক।এবারের এশিয়া কাপের আগে টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ ছিল এক আক্ষেপের নাম। যে দলটা ওয়ানডে ক্রিকেটে এতটা উজ্জ্বল সে দলটা টি২০তে এত অনুজ্জ্বল কেন, এই প্রশ্নে জবাব খুঁজেছে ১৬ কোটি মানুষ। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করা বাংলাদেশ ৪ ম্যাচ টি২০ সিরিজে মাঠ ছেড়েছে ২-২ সমতায়। সব থেকে বড় কথা ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও শেষ দুটো ম্যাচে হেরেছে মাশরাফিরা।  জিম্বাবুয়ের সঙ্গে পর পর দুটো ম্যাচে হারের তেতো স্বাদ নিয়েই এশিয়া কাপ মিশনে নামে স্বাগতিক বাংলাদেশ। একটা সাদামাটা দলের বিপক্ষে এমন হারের পর মাশরাফি বললেন-‘টি২০ ক্রিকেটে আমরা এখনও নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারিনি। দল হয়ে উঠতে পারিনি। এশিয়া কাপ থেকে আমাদের বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিতে হবে। গুছিয়ে উঠতে হবে, দল হয়ে উঠতে হবে।’ দল হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ নিয়েই এশিয়া কাপ অভিযাত্রা শুরু হয় টাইগারদের। উদ্বোধনী ম্যাচে দুর্দমনীয় ধোনিদের মুখোমুখি হওয়ার আগে দল গোছানোর অগ্নিপরীক্ষার সঙ্গে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টানা দু’ম্যাচ হারের ক্ষত, মাশরাফিদের সামনে চ্যালেঞ্জটা হয়ে দাঁড়ায় চীনের মহাপ্রাচীরসম।এশিযা কাপের উদ্বোধনী ম্যাচের বাংলাদেশ আর ফাইনালের বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি দল। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালের মর্যাদায় উন্নীত হওয়া ম্যাচে মাঠে নামার আগেই ইনজুরির কারণে বাইরে চলে গেলেন দলের সবচেয়ে বড় ট্রাম্পকার্ড মুস্তাফিজুর রহমান। এত বড় ধাক্কাও লক্ষ থেকে সরাতে পারেনি টাইগারদের। মুস্তাফিজের শূন্যস্থান বুঝতেই দেননি বাকি বোলাররা।  পাকিস্তানকে ১২৯ রানে আটকে রেখে জয়ের ভিতটা গড়ে দেন বোলাররা। প্রথম ৩ ওভার থেকে একটি মেডেনসহ মাত্র ২ রান দেন তাসকিন আহমেদ। নির্ধারিত ৪ ওভারে ১৪ রান। চমৎকার লাইন-লেংথে প্রতিটি ডেলিভারি ১৪০- ১৪৫ কিমি গতিতে ছুঁড়ে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের কার্যত ক্রিজের সঙ্গে বেঁধে রাখেন বাংলাদেশের স্পিড স্টার। পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর মাশরাফি বলেন- ‘মুস্তাফিজ যে কাজটা করে থাকে তাসকিন সেটা করে দিয়েছে।’ বাংলাদেশ অধিনায়কের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটি, টিম টাইগার্স। একজনের  শূন্যস্থান পূরণের জন্য জানবাজি রেখে লড়ে যাওয়ার মানসিকতা এটাই স্বাগতিকদের বড় পুঁজি।ফাইনালের বাংলাদেশকে র‌্যাংকিংয়ের বৃত্তবন্দী করে রাখার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতেই হচ্ছে সবাইকে। চোখ বন্ধ করে এই এশিয়া কাপে বল হাতে সেরা পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আমির। পুরো আসর জুড়েই ব্যাটসম্যানদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন এই ফাস্ট বোলার। আর তাই পাকিস্তানের বিপক্ষে  ম্যাচে আমিরকে নিয়ে একটা দুর্ভাবনা ছিলই। এই আমিরকে মাঠে নেমেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিলেন তামিম ইকবাল খান। খেলছেন আসরের প্রথম ম্যাচ। নতুন বল হাতে ব্যাটসম্যানদের যমদূত বিবেচিত আমির। ইনিংসের মাত্র দ্বিতীয় বল। ফ্লিক করে বলকে শূন্যে ভাসিয়ে সীমানা ছাড়া করলেন বাঁহাতী ওপেনার তামিম। মানসিকভাবে অনেকটাই এগিয়ে গেল টাইগাররা।  ফাইনালের বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হলে হিসাবে আনতে হবে এ বিষয়গুলোও। ইনিংসের মাত্র দ্বিতীয় বলে প্রতিপক্ষের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বোলারকে এভাবে ছক্কা মারার মানসিক জোরটাই ফাইনালের বাংলাদেশ।ফাইনালের বাংলাদেশ মানে টিকে থাকার ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাব্বির রহমানের মাত্র ৫৪ বলে ৮০ রানের ঝড়। সাব্বির বীরত্বের পর বাংলাদেশের ফাইনাল খেলাটা পরিণত হয় সময়ের দাবিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে ছিড়ে গেছে র‌্যাংকিংয়ের মনস্তাত্বিক বাধা। একতরফা ওই ম্যাচে পাকিস্তান ম্যাচে ফেরার সুযোগ পেয়েছিল শুধু একবারই।  আর সেটা হয়েছিল মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসানের আত্মঘাতি শট খেলার কারণে। দলের ব্যাটিংয়ের অন্যতম দুই স্তম্ভ পরপর বিদায় নেয়াতে লড়াইয়ে ফেরে পাকিস্তান। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মুশফিক-সকিবের ভুলকে আর বাড়তে দেননি মাশরাফি-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। উইকেটে এসেই আমিরকে পর পর দু’ বলে বাউন্ডারি মেরে শুধু বলকেই সীমানার বাইরে পাঠালেন না, পাকিস্তানকেও এশিয়া কাপের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। আর রিয়াদ কালবোশেখি তো এবারের এশিয়া কাপের বাড়তি আকর্ষণ।র‌্যাংকিংয়ের দশ নম্বর আজ নাম্বার ওয়ানদের জন্য দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত হয়ে দেখা দিতে পারে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না কোনোভাবেই। এইচআর/এমএস