ঈদের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নন-এসি বাসগুলো বাড়তি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছে। এতে একদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে সরকারের উদ্যোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। অপরদিকে ঈদের শেষে কর্মস্থলে ফেরা মানুষ অর্থনৈতিক চাপে পড়ছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুসারে, ঈদকে সামনে রেখে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। আবার সমপরিমাণ মানুষ বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে ফিরবেন। এরমধ্যে একটি বড় অংশই রয়েছে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার।
বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) বগুড়ার ঠনঠনিয়া বাসেস্ট্যান্ডে অপেক্ষমান চাকরিজীবী মনির হোসেন বলেন, তিনি ১৬০০ টাকা দিয়ে মানিক পরিবহনের আরএমটু গাড়ির টিকিট কেটেছেন। নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম নেওয়া হলেও তিনি মেনে নিয়েছেন একটু আরামের জার্নি করবেন বলে। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখেন একটি সাধারণ মানের বাসকে আরএমটু গাড়ির মতো করে রূপান্তর করা হয়েছে। এই গাড়ির এসি ঠিকমতো কাজ করে না। এটা দেখে তিনি কাউন্টারে এসে টিকিট ফেরত দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু তাকে অনেক কম দাম বলা হচ্ছে।
এছাড়া রংপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে হানিফ এন্টারপ্রাইজের এসি বাসের ২টি টিকিট কিনেছেন ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন। তিনি আগামী ২৮ এপ্রিল রংপুর থেকে ঢাকা যাবেন। টিকিটের জন্য তাকে অতিরিক্ত ৯০০ টাকাসহ ২ হাজার ৪০০ দিতে হয়েছে। অর্থাৎ ২টি টিকিটের দাম পড়ছে ৪ হাজার ৮শ টাকা। অথচ কয়েকদিন আগেও প্রতি টিকিটের দাম ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা।
সহজ ডট কম থেকে যারা অনলাইনে টিকিট কাটছেন তাদেরকেও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। গাইবান্ধায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে আলহামারা পরিবহনের এসি কোচের টিকিটের দাম রাখা হচ্ছে ১৮শ’ টাকা। অথচ সাধারণ সময় এই টিকিটের দাম নেওয়া হয় ৯০০ টাকা।
পঞ্চগড় থেকে ঢাকাগামী হানিফ এন্টারপ্রাইজের এসি কোচের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকা। সাধারণ সময় এই ভাড়া ২ হাজার করে নেওয়া হয়।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের জেনারেল ম্যানেজার মোশাররফ হোসেন বলেন, উত্তরবঙ্গগামী অন্যান্য এসি বাস অপারেটরদের মতো আমরাও ভাড়া বাড়িয়েছি। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও ঈদকে ঘিরে রাস্তায় যানজটের কারণে আমাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে এসির মতো অনেক নন-এসি বাস সার্ভিসও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবু রায়হান বলেন, সাধারণত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম টাকা রাখি। এখন আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়াই নিচ্ছি। যাত্রীরা মনে করছেন, বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এটা সত্য নয়।
এসি বাসের ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু ঈদের সময় গাড়িগুলোকে ঢাকায় ফাঁকা ফিরতে হয় তাই বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
এক তথ্যে জানা গেছে, ঈদের আগের দুই দিনে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। আবার একই পরিমাণ মানুষ গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়। অথচ দেশের মূল গণপরিবহন বাস, ট্রেন ও লঞ্চে দিনে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে সাড়ে ১০ লাখের মতো। চাহিদা ও যোগানের এই বিরাট পার্থক্যের সুযোগে দুই দিন ভাড়া নিয়ে চলে নৈরাজ্য। এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরও দূর হয়নি সেই নৈরাজ্য। পরিবহন স্বল্পতার অযুহাতে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের কাছে থেকে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাসে যাতায়াত বেড়েছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষের মূল যাতায়াত বাসে। গত ঈদুল ফিতরে দূরপাল্লার পথে বিপুল যাত্রী ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলে বাড়ি গেছেন। এবার সরকার ঈদে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে নির্দেশনা দেয়। যার কারণে মোটরসাইকেল ছিল অনেক কম। এ সুযোগে বাস মালিক-শ্রমিকেরা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভয়ংকর ব্যাপার হলো সাধারণ মানের বাসে শুধু এসি লাগিয়ে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।
বগুড়ার ঠনঠনিয়া, চারমাথা বাস টার্মিনাল ও বনানী, তিনমাথা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনো কোনো বাসে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করা হচ্ছে। বাসগুলোতে মোড়া দিয়ে, চালকের পাশে গাদাগাদি করে বসিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। শুক্রবার পর্যন্ত এই চাপ থাকবে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বাড়তি ভাড়া যাতে আদায় না হয়, সেজন্য আমরা লোক নামিয়েছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার এসি বাসের ভাড়া ঠিক করে দেয় না। এজন্য পরিবহন মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করেন। আবার বড় কোম্পানির বাইরে অন্যান্য পরিবহন অগ্রীম টিকিট বিক্রি করে না। যাত্রার আগে আগে যাত্রীদের কাছ থেকে কর্মীরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে।
পরিবহন খাতের সূত্রগুলো জানায়, ঈদ উপলক্ষে বড় কিছু পরিবহন কোম্পানি অগ্রীম টিকিট বিক্রি করে। সেই টিকিট ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটি চক্র এই টিকিটের একটা অংশ কিনে রাখে। শেষ দিকে তারা চড়া দামে এসব টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করে।
এফএ/জেআইএম