দেশজুড়ে

নওগাঁয় অনলাইন সেবা চালু হলেও কমেনি দালালের দৌরাত্ম্য

নওগাঁয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসে অনলাইন সেবা কার্যক্রম চালু হলেও ভোগান্তি যেন পিছু ছাড়ছে না। ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেতে সেবাপ্রার্থীরা এখনো মধ্যস্থতাকারীর (দালাল) শরণাপন্ন হচ্ছেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালরাও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যার একটি অংশ চলে যাচ্ছে অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পকেটে।

নওগাঁ বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য গ্রাহককে প্রথমে লার্নার বা শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ অনলাইনে আবেদন করতে হবে। নির্ধারিত ফি প্রথম ক্যাটাগরিতে ৫১৮ টাকা ও দ্বিতীয় ক্যাটাগরির জন্য ৭৪৮ টাকা অনলাইনে পরিশোধ করতে হবে। এরপরই লার্নার বা শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু হবে। গ্রাহক সঙ্গে সঙ্গে তার শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্ট করে নিতে পারবেন। এরপর ২-৩ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তাকে নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে নির্ধারিত কেন্দ্রে লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্টে অংশ নিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুনরায় একটি নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ফি দিয়ে স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসে আবেদন করতে হবে গ্রাহককে।

গ্রাহকের বায়োমেট্রিক (ডিজিটাল ছবি, ডিজিটাল সই ও আঙুলের ছাপ) গ্রহণ করা হলে স্মার্টকার্ড ইস্যু করা হয়। স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্টিং সম্পন্ন হলে গ্রাহককে এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। নির্ধারিত ফি (পেশাদার ২ হাজার ৭৭২ টাকা ও অপেশাদার ৪ হাজার ৪৯৭ টাকা) বিআরটিএর নির্ধারিত ব্যাংকে জমা দিয়ে রসিদ নিতে হবে।

তবে সরেজমিন দেখা গেছে, ভোগান্তি থেকে বাঁচতে এখনো দালালদের কাছে ছুটছেন সেবাপ্রার্থীরা। যারা দালাল ধরে কাজ করেছেন তারা এখনো জানেন না অনলাইনে ঘরে বসে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করা যায়। গ্রাহকভেদে ইচ্ছামতো টাকা নিচ্ছেন দালালরা। কামরুল, মানিক ও আতিকসহ কয়েকজন বিআরটিএ অফিসের চিহ্নিত দালাল বলে পরিচিত।

২৫-২৭ এপ্রিল দুদিন নওগাঁ বিআরটিএ অফিস ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বুধবার (২৬ এপ্রিল) টিটিসিতে ছিল ড্রাইভিং পরীক্ষা। সেবাপ্রার্থীরা জানান, অনলাইনে যদিও ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করা যায় তারপরও লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্টের ঝামেলা এড়াতে দালালের সাহায্য নেন তারা। কেননা একবার ফেল (অকৃতকার্য) হলে আবারও অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে ও সময় লাগবে। এছাড়া মানুষও এখনো অনলাইন বুঝে ওঠেনি।

নওগাঁ শহরের জগৎসিংহপুর মহল্লার বাসিন্দা শাহজাহান মণ্ডল। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির পেশাদার ট্রাকচালক। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন।মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) কাগজপত্র হাতে নিয়ে বিআরটিএ অফিসের সামনে অপেক্ষা করছিলেন।

শাহজাহান মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘হালকা এবং মিডিয়াম ধাপের লাইসেন্স দিয়ে এতদিন গাড়ি চালিয়েছি। সে সময় লাইসেন্স পেতে নিজেই কাগজপত্র সম্পূর্ণ করেছিলাম। দুই বছর আগে কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন রাস্তায় বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। তাই ভারী যানের লাইসেন্স পেতে চেষ্টা করছি। দ্রুত যাতে লাইসেন্স পাওয়া যায় সেজন্য ১০ হাজার টাকায় দালাল ধরেছি।’

২০১৯ সালে মোটরসাইকেল ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রক্রিয়া শুরু করেন শহরের সুলতানপুর মহল্লার খোরশেদ। তিনি বলেন, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য দালাল ধরেছিলাম। চুক্তি করে টাকাও দিয়েছিলাম। তবে আজকাল হবে বলে কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। অবশেষে তাকে চাপাচাপি শুরু করলে কাজটি করে দিতে বাধ্য হয়। এরমধ্যে লাইসেন্সের ফি বেড়ে গেছে। তারপরও ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’

পত্নীতলা উপজেলার নয়ন ও আলমগীর বলেন, কুদ্দুস নামে একজনকে দিয়ে হালকা যান (মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস) লাইসেন্স করাচ্ছি। তার সঙ্গে ১২ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছে। তবে সরকারিভাবে কত টাকা লাগে জানি না। কাজ যেন দ্রুত হয় তাই দালাল ধরেছি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হবে মোবাইলে এমন মেসেজ পেয়ে বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে বিআরটিএতে এসেছিলাম। কার্ড নিতে এসে শুনলাম বিকেল ৩টা থেকে বিতরণ করা হবে। কিন্তু বিকেলে আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে এক মাধ্যমে ২০০ টাকা দিয়ে কার্ডটি সংগ্রহ করেছি। টাকা যাক, সময়টা মূল্যবান।’

নওগাঁ বিআরটিএ অফিসের একজন দালাল মো. মানিক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মোটরসাইকেল শোরুমে চাকরি করার সুবাদে বিআরটিএ অফিসে নিয়মিত আসা-যাওয়া। এ সুযোগে তিনি কিছু লাইসেন্সের কাজ করে দেন। যাদের কাজ করে দেন তারা খুশি হয়ে তাকে কিছু দেন। তবে অফিসের কারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের নাম বলতে চাননি তিনি।

দালাল রেজাউল ইসলাম বলেন, অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন চালু হওয়ায় আমাদের কাছে লোকজন আসা কমে গেছে। এতে আয়ও কমেছে। ঈদের পর গত চারদিনে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় হয়েছে। অথচ গতবছর প্রতিদিন অন্তত হাজার টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।

এ বিষয়ে নওগাঁ বিআরটিএর সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মোহাম্মদ হারুন উর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্যক্রম অনলাইনে চালু হওয়ায় আমাদের জন্য সুবিধা হয়েছে। অফিসে চাপও কমেছে। একই দিনে ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে। আবেদনের দুই মাসের মধ্যে ড্রাইভিং প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে প্রার্থী তার স্মার্টকার্ড ডাকযোগে হাতে পেয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, সবাই এখনো অনলাইন বুঝে ওঠেননি। তাই হয়তো একটু ভোগান্তি হচ্ছে। আগামী দুই বছরে ভোগান্তি কমে যাবে।

দালালদের বিষয়ে বিআরটিএর সহকারী পরিচালক বলেন, তৃতীয় পক্ষের সহযোগিতা নিতে গিয়ে অনেকেই বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। তবে আমাদের অফিস দালালমুক্ত। তাদের সঙ্গে অফিসের কারও কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এএএল/এসআর/জিকেএস