শৈশব থেকেই শুনে আসছেন কালো মেয়ে বলে বিয়েতে বাবার অনেক টাকা খরচ হবে। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের মানুষের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে বেশি বিরক্ত হতো। সেই থেকেই আঘাতগুলো মনের গহীনে বাসা বেধেছিল। মনে মনে পণ করেছিলেন টাকার বিনিময়ে কোন বিয়ে মেনে নিবেন না। যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলবেন একজন প্রতিভাময়ী নারী হিসেবে। যেই কথা সেই কাজ। মেধা দিয়ে নিজেকে গড়েও তুলেছেন সাফল্যের চূড়ায়। এরপর বাবার দুশ্চিন্তাকে পেছনে ঢেলে যৌতুক নয় আমেনা বেগমকে সম্মানের সঙ্গেই বিয়ে করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সানিয়াৎ লুৎফি। এক সময়ের কালো মেয়ে আমেনা বেগম বর্তমানে নরসিংদী জেলার প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এখন গোটা নারী সমাজের কাছে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। শুধু দেশে নারী সমাজের কাছে নয় বিশ্বের একাধিক স্থানে নারীকে তুলে ধরেছেন তার মেধা আর মনন দিয়ে। সেই কালো মানিক এখন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন।পুলিশের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় দায়িত্ব নিয়ে পালন করছেন সমাজ গঠনের কাজ। ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে তিনি নরসিংদী পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি পুলিশ সপ্তাহ-২০১৫ তে দক্ষতার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পেয়েছেন তিনি।আমেনার বেগমের শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। লেখাপড়া শুরু করেছেন আগ্রাবাদ সরকারি কলোনি বিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই কাজের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের কাজেও নিয়মিত মাকে সাহায্য করতেন। কিশোরী বয়স থেকেইে বাবা শিখিয়েছেন পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি জীবনে সাজাতে হলে সকল ব্যবহারিক কাজেও দক্ষতা থাকতে হবে। ভাইদের কাছ থেকে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। এক টেবিলে বসেই পড়াশোনা করতেন ভাইদের সঙ্গে। শিখেছেন সেলাই কাজ, করতেন স্ক্রেচিং ও এম্ব্রয়ডারি কাজ। নারীর প্রতি বৈষম্য কখনও অনুভূতিতে আঘাত করেছে কিনা জানতে চাইলে হেসে বলেন, অন্যের কথা কি বলব আমি নিজেই তো বৈষম্যের শিকার। ভাইরা সারা দিন ঘোরাঘুরি করতো আর আমি সারা দিন কাজ করতাম। বাসায় সব কাজ আমাকেই করতে হতো। আমার ভাই আমাকে খুব কড়া শাসন করতো। এখন আমাকে কেউ কড়া কথা বললে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারি। সে সময় আমাদের কলোনিতে কাস্টমসের একজন নারী অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ছিলেন। ওনার নাম ছিল রাশেদা বেগম। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রাশেদা বেগমকে অনুসরণ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে জীবনকে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই। তার প্রেরণাকে লালন করে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাই।আমেনা বেগম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করে ১৯৯৯ সালে ১৮ তম বিসিএস (বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। এরপর বালাদেশ পুলিশ সার্ভিসে নিজেকে নিয়োজিত করেন। চাকরি জীবনে প্রথমে কুমিল্লা জেলায় সহকারী পুলিশ সুপার (শিক্ষানবিস) হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। পরে ২০০৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও পরে র্যাব সদর দফতরে যোগ দেন। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্ব তিমুরে বাংলাদেশ আর্মড পুলিশ ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ।২০০৯ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমেনা বেগম আন্তর্জাতিক নারী পুলিশ সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক পদে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় মেয়াদেও এই দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের ‘প্রথম এশিয়ান উইমেন পুলিশ কনফারেন্স’ এ সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। আমেনা বেগম ‘বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক’ এরও প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (এসপি), এআইজি (হাইওয়ে পুলিশ) এবং পার্বত্য রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। এসব দায়িত্ব পালনকালে ২০১২ সালে ‘আইজেন হওয়ায় ফেলোশিপ’ এর জন্য মনোনয়ন প্রাপ্ত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যসহ ১৬টি অঙ্গরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পুলিশিং এর উপর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এছাড়া মেক্সিকো, ইউএসএ, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ইউরোপে পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়ে সারাবিশ্বে নারী পুলিশ হিসেবে অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সানিয়াৎ লুৎফীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর চাকরির সুবাধে আমেনা বেগম বিভিন্ন জেলায় থাকলেও স্বামী সানিয়াৎ থাকেন চট্টগ্রামেই। তাদের রয়েছে একটি কন্যা সন্তান। পুলিশ সুপার হিসেবে পুরো জেলার আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকেন সব সময়। পাশাপাশি একজন সচেতন মা হিসেবে সন্তানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন যথাযথভাবে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সমাজে নারী পুরুষের ভেদাভেদকে পাশ কাটিয়ে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সুপার আমেনা বেগম। নিজের পরিবারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সমানভাবে। কোন জড়তা না রেখে সন্তানকে কোলে নিয়েই অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন সভা সেমিনারে।আমেনা বেগম বলেন, আমি যখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করি তখন নিজেকে শুধু রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা মনে করি। যেখানে আমার যে সম্পর্ক সে অনুযায়ী চলার চেষ্টা করি। নারীদের উন্নয়নে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আমার ইচ্ছা ছিল বলেই লেখাপড়া করে আজ এ পর্যন্ত এসেছি। আর আমার যদি স্বপ্ন না থাকতো তাহলে পরিবার চাইলেও তা হতো না। তাই প্রতিটি নারীকেই নিজেদের পথ নিজে তৈরি করতে হবে। তবে সাংবাদিকরা সফল নারীদের নিয়ে লেখালেখি করার ফলে অনেক নারীই অনুপ্রাণিত হবেন। সে সময় বেগম রোকেয়াদের তো অনেক কষ্ট করেতে হয়েছে। কিন্তু এখন তো পরিবেশ অনেক পাল্টেছে। তবে বাবা-মা মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমার অনেক মেধাবী বান্ধবীর কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজনের শারীরিক সমস্যার কারণে মৃত্যু হয়েছে ও একজনের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
নারী পুলিশ সুপার হওয়ায় কোন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার অধীনে যারা কর্মরত আছেন তাদের সঙ্গে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু উপর লেভেল থেকে একটু চাপ বেশি পড়ে। আমি যদি কাজ করেও বাসায় যাই তাহলেও বলবে মহিলা মানুষ বলে নাকি বাসায় থাকি। এছাড়া নারীদের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য বেশি কাজ করে দেখাতে হয়। এই প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পেশাগত ক্ষেত্রে নারী আর পুরুষ নয় আমদের কাজ করতে হয় কর্মকর্তা হিসেবে। তবে এর একটা সামাজিক প্রভাব রয়েছে। আপনাদের মাধ্যমে প্রচারের ফলে অনেকেই এতে উৎসাহ পাবে। যেমন আমি দিল্লির কিরন বেদির বিষয়টি জেনে খুব সাহস পেয়েছি। কমিশনার এর দায়িত্ব না পাওয়ার কারণে তিনি এর প্রতিবাদ করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি নারীদের জন্য জেলার বিভিন্ন থানায় নারী সহায়তা কেন্দ্র চালুর কাজ শুরু করেছেন। পেশাগত দায়িত্বের পালনের পাশাপাশি তিনি অটিস্টিক চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত আছেন। এছাড়া আমেনা বেগম সুযোগ পেলেই নারীদের পুলিশে যোগদানের বিষয়ে নিয়মিত উৎসাহ দেয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন।এসএস/এআরএস/আরআইপি