তাহমিনা বেগম মুকুল। অসহায়, হতাশাগ্রস্থ নারীদের কর্মসংস্থানের পথ প্রদর্শনের এক মূর্তপ্রতিক। অথচ স্বামীর কাছ থেকে তালাক প্রাপ্তি, মায়ের মৃত্যু, বাবার দ্বিতীয় বিয়ে এবং সম্পত্তির লোভে ভাইদের শত্রুতায় একসময় জীবনে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল তার। জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ এবং বিষাদময়।শহরের মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত মেয়ে হলেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে, স্বাবলম্বী হতে হাতে তুলে নিয়েছেন কাঁচি-সুঁই-সুতা। শেরপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেটে দোকান ভাড়া নিয়ে করছেন টেইলারিংয়ের ব্যবসা। তার টেইলার্সের নাম ‘আসসালামু আলাইকুম লেডিস টেইলার্স অ্যান্ড সেলাই প্রকল্প। সাথে রয়েছে ব্লক, বাটিক, টাইডাই, হ্যান্ডিক্রাফটস, নকশি কাঁথা, চাদরসহ এ্মব্রয়ডারীর কাজ। সম্প্রতি তিনি টিস্যু কাপড় দিয়ে শপিং ব্যাগ তৈরির কাজও করছেন, নেমেছেন ধানের ব্যবসাতেও।তাহমিনা বেগম মুকুল কেবল নিজেই স্বাবলম্বী হননি। তার মত অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের পথ খুলে দিয়েছেন তিনি। দুঃস্থ, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তাদের জন্য হ্যন্ডিক্রাফটস তৈরির মাধ্যমে উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছেন। তার টেইলার্সে স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত ১৭ জন মহিলা ও ১০ জন পুরুষ মেশিনে সেলাইয়ের কাজ করছে।এছাড়া প্রায় ১১০ জন মহিলা তার অধীনে কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে সুচ-সেলাই ও শপিং ব্যাগ তৈরির কাজ করছে। এদের সবাই সমাজের সুবিধা বঞ্চিত। তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে-কাজ করে গত ১৫/১৬ বছরে ২৬৫ জন অসহায় মহিলা স্বাবলম্বী হয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর অনেক বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও তালাকপ্রাপ্ত মহিলা নতুন করে ঘর-সংসার করছেন। এসব অসহায় মহিলার জীবনে তিনি ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন।বুকভরা দুঃখ দিয়ে তাহমিনা বেগম মুকুল সংগ্রাম করে চলেছেন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। অল্প বয়সে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর এইচ.এস.সি পাশ করেন। এইচ.এস.সি পরীক্ষার পূর্বে ব্যাংকার স্বামী ও স্বামীর বাড়ির লোকজনের নির্যাতনের স্বীকার হয়ে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। একসময় নির্যাতন সইতে না পেরে বাবার বাড়ি চলে আসেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে চাকরি খুঁজতে থাকেন। কিন্তু চাকরি নামক সোনার-হরিণটা অধরাই থেকে যায়। পরে বি,এ পাশ করেন। এরই মধ্যে তার মা মারা যান। এ সময় বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং স্বামীও দ্বিতীয় বিয়ে করে তাকে তালাক দেন। পরে ভাইয়েরা মায়ের সম্পত্তির জন্য শত্রুতা শুরু করলে একসময় বাবার বাড়িও ছাড়তে হয় তাকে।এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছোট বোনের স্বামী আইন উদ্দিন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সাদুল্লাহ হোসাইন বিপুলের সহযোগিতায় তাহমিনা বেগম মুকুল যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে একটি সেলাই প্রকল্প চালু করেন। দুঃস্থ, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, নির্যাতিতা ৫০ জন নারীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে সে প্রকল্প। প্রকল্প চলাকালীন সময়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহায়তায় এস.ই.ডি.পি (Small Entrepreneur Development Product) থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ লাভ করেন। এসএমই ফাউন্ডেশন এবং চেম্বার থেকেও পরে তিনি উদ্যেক্তা প্রশিক্ষণ নিয়ে টেইলার্সের পাশপাশি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।এভাবেই একটি টেইলার্সের দোকান থেকে আজ তিনটি টেইলারিং কারখানার মালিক হয়েছেন তিনি। চুক্তি ভিত্তিতে গ্রামীণ অসহায় মহিলাদের দিয়ে শপিং ব্যাগ তৈরি করে বাজারজাত করছেন। জড়িয়েছেন ধানের ব্যবসায়ও। সদস্য হয়েছেন শেরপুর চেম্বারের। এছাড়া তিনি শেরপুর উইমেন চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক কমিটিরও সদস্য। বর্তমানে পোষাক, সেলাই প্রকল্প, শপিং ব্যাগ ও ধানের ব্যবসা মিলিয়ে তিনি কারিগর-শ্রমিকদের মাসে ৬০/৬৫ হাজার টাকা মজুরী বাদে প্রায় ৪০/৪৫ হাজার টাকা মুনাফা করছেন এবং দিন দিন ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছেন।শহরের নিউমার্কেটে নিজ প্রতিষ্ঠান ‘আসসালামু আলাইকুম লেডিস টেইলার্সে বসে আলাপ হয় তাহমিনা বেগম মুকুলের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিয়ের পর ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাশ করি। স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজন পড়াশুনার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী সেলিম মিয়ার চাকরি হয় কৃষি ব্যাংকে। গ্রাম থেকে শহরে চলে আসি। পড়াশুনার প্রবল আকাঙ্খায় স্বামীর বাধার মুখেও কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু স্বামীর অসহযোগিতায় যথাসময়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এভাবে কেটে যায় ৫ বছর। ইতোমধ্যে ১৯৮৫ সালে গর্ভে সন্তান আসে আর আমার উপর চলতে থাকে স্বামীর নির্যাতন।তিনি আরো বলেন, সন্তান ও সামাজিকতার স্বার্থে সবকিছু নিরবে সহ্য করেছি। এমনকি বাবা-মাকে পর্যন্ত বলিনি। ১৯৮৮ সালে স্বামীর অজান্তে এইচ.এস.সি পাশ করি। এ সংবাদ পাওয়ার পর স্বামীর নির্যাতন আরো বেড়ে যায়। ১৯৯০ সালে সন্তানের সাড়ে ৪ বছরের বয়সকালে স্বামী গোপনে ফের বিয়ে করে। ৪ মাস পর এ ঘটনা জানতে পারি। তখন আর স্বামীর ঘরে যাইনি। এভাবেই কেটে যায় প্রায় ১০ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে স্বামী কোনো খোঁজখবর নেয়নি। সন্তানকে নিয়ে বাবার সাথে থাকতে লাগলাম।১৯৯৬ সালে মা মারা যান। ২০০০ সালে স্বামী ডিভোর্স লেটার পাঠায়। ডিভোর্সের পর ২০০১ সালে বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করেন। অসহায় হয়ে পড়ি। মার সম্পত্তি নিয়ে ওয়ারিশের দ্বন্দ্বে ভাইয়েরাও আমার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। তখনই বাবার বাড়ি ছেড়ে বাসা ভাড়া নিয়ে জীবন সংগ্রামে ঝপিয়ে পড়ি। শুরু হয় একলা পথচলা। যুব উন্নয়নের প্রশিক্ষণ আমার চোখ খুলে দেয়।তিনি বলেন, নিঃসঙ্গ জীবনে ছোট বোন জামাই অধ্যাপক বিপুলের পরামর্শ ও সহযোগিতায় ২০০১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতরে ৪ মাসের সেলাই, কাটিং ও ডিজাইনের প্রশিক্ষণ নেই। এ প্রশিক্ষণের পরপরই বিসিক থেকে ৫ দিনের ‘ব্যবসায় বিপণন ও বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর কোর্স করি। প্রশিক্ষণ শেষে ওই ছোটবোন জামাইর কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ধার নেই। ২ হাজার টাকায় ১০ টা প্রাইডের শাড়ী কিনে ১০ জন মহিলাকে দিয়ে সেগুলোকে ব্লক ও বাটিকের কাজ করে বিক্রি করি। প্রতি পিস শাড়ী ৫০০ টাকা করে বিক্রি শেষে মোট ৫০০ টাকা লাভ হয়। এভাবে দেড় বছর চলার পর ১৫ হাজার টাকার পুঁজি বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার টাকায়।প্রথমদিকে লাভ হলেও এক সময় ব্যবসায় ধাক্কা লাগে। হ্যান্ডিক্রাফটসের বিভিন্ন রকমের তৈরী জিনসপত্র শাড়ী, চাদর, সালোয়ার-কামিজ, পার্স, ব্যাগ, সোফা-কভার, কুশন-কভার, ইয়োক হঠাৎ আটকে যায়। দোকানীরাও নেই-নিচ্ছি করে মাল নিতে গড়িমসি শুরু করে। একপর্যায়ে হতাশ হলেও দমে না গিয়ে টেইলারিংয়ের কাজে নেমে পড়ি।তাহমিনা বেগম মুকুল তার প্রকল্পের নাম দিয়েছেন ‘আসসালামু আলাইকুম লেডিস টেইলার্স অ্যান্ড সেলাই প্রকল্প। টেইলার্সে কেবলমাত্র মহিলা ও শিশুদের পোষাক তৈরি করা হয়। মহিলা দ্বারা পরিচালিত একমাত্র লেডিস টেইলার্স হিসাবে শহরে এর চাহিদাও প্রচুর। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২৬৫ জন মহিলাকে টেইলারিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যারা এখন আত্মকর্মে নিয়োজিত। তন্মধ্যে যাদের সামর্থ আছে ৩ মাস প্রশিক্ষণে তাদের নিকট থেকে ১৫শ’ টাকা এবং দুঃস্থদের বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। টেইলারিং এবং কুটিরশিল্পের মাধ্যমে তাহমিনা বেগম মুকুলের প্রকেল্প প্রতিমাসে প্রায় এক লাখ টাকার কাজ হয়।তাহমিনা বেগম মুকুল অসহায় অবস্থা থেকে আজ আত্মমর্যাদাশীল মহিলা হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলেন, শুণ্য হাতে যাত্রা করে কেবল প্রশিক্ষণের ওপর ভর করে আজ আমি প্রায় ২০ লাখ টাকার মালিক। অনেকের কর্মসংস্থান করতে পেরেছি। সমাজে আজ আমার একটা অবস্থান আছে। পুরুষের মতো আমিও একজন উদ্যোক্তা। ভাবতেই ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। অসহায় নারীদের প্রতি তাহমিনা বেগম মুকুলের একটি পরামর্শ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, পরের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে যতক্ষণ নিজে পারা যায় কিছু করার চেষ্টা করা উচিৎ। এতে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। নিজের স্বাবলম্বীতা বড় জিনিস। কখনো ভাবিনী টেইলারিংয়ের কাজ করবো। অথচ এটাই আজ নিয়তি। কিন্তু আজ এ কাজের জন্যই আমি সামাজিক ও আর্থিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। নিজের খচর নিজে চালাই। আত্মীয়স্বজন, পরিবারের লোকদেরকেও সাহায্য করতে পারছি। শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছি। সবই হয়েছে হাতের কাজ জানা থাকা ও পড়াশোনার কারণে। এজন্য সব মেয়েকেই ধৈর্য্য হারা না হয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি হাতের কাজ শেখার উপর জোর দেন তিনি।এফএ/এমএএস/এমএমজেড/পিআর