মতামত

শিশুশ্রম রোধে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুদের অধিকার রক্ষা এবং ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম দূর করার জন্য ২০০২ সাল থেকে ‘বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস’ (World Day Against Child Labour) পালন করে আসছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর ১২ জুন এ দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির থিম বা প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার। শিশুশ্রম বন্ধ করুন’ (Social Justice for All. End Child Labour!)।

Advertisement

জাতিসংঘ বলছে, কয়েক বছর ধরে, দ্বন্দ্ব, সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী আরও বেশি পরিবারকে দারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে– এবং আরও লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য করেছে। এসব কারণে অনেক দেশে অনেক পরিবার এবং সম্প্রদায় যে আর্থিক চাপ অনুভব করে, যা তাদের তাদের শিশুদের কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য করে। এ থেকে থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, বা যথেষ্ট অন্তর্ভুক্তিমূলকও নয়। বিশ্বব্যাপী আজও ১৬ কোটি (১৬০ মিলিয়ন) শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতি দশজনের মধ্যে একজন শিশু শিশুশ্রমে নিয়োজিত।

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। দশ বছরেরও বেশি আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর ২০১৩ সালে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, ৩ কোটি ৯৬ লাখ শিশুর ৯ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ, ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনো শ্রমে নিয়োজিত ছিল। এর মধ্যে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত ছিল ।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শ্রমদানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪৭ লাখ, যা ৫-১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ১৩.৪ শতাংশ। আর এই শিশুশ্রমিকদের ৮৩ শতাংশের অবস্থানই গ্রামাঞ্চলে এবং মাত্র ১৭ শতাংশ শহরাঞ্চলে। তবে বাস্তবে শিশুশ্রমিকের এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলেই প্রতীয়মান হয়।

Advertisement

বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তাদের ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এবং মজুরিও অনেক কম। বিষয়টি তদারকি করার দায়িত্ব কেউ নেয় না। আর্থ-সামাজিক ও উন্নয়নের দিক থেকে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য শর্ত নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত পথশিশু জরিপ ২০২২-এ দেশের পথশিশুদের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দারিদ্র্য, পারিবারিক অশান্তি, খাবারের অভাবসহ নানা কারণে শিশুরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ শিশু তাদের পরিবারের কাছে ফিরতে চায় না।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯২.১ শতাংশ ছেলে এবং ৮৪.৫ শতাংশ মেয়ে শিশু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। ২০.৯ শতাংশ পথশিশু বর্জ্য তুলে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া ১৮.৪ শতাংশ পথশিশু ভিক্ষা করে বা ভিক্ষা করতে সাহায্য করে। জরিপের তথ্যে পথশিশুদের চরম দুর্দশা দেখা যাচ্ছে। এর আগে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে শিশুরা প্রায় ৩০১ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছে। শিশুরা বেশির ভাগই হকারি, কুলিগিরি, রিকশা চালানো, পতিতাবৃত্তি, ফুল বিক্রি, আবর্জনা সংগ্রহ, ইট-পাথর ভাঙা, হোটেলের কাজ, মাদক বহন, ওয়েল্ডিং কারখানার কাজ, ইত্যাদিতে নিয়োজিত। তবে এই জরিপে পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা কত তা বের করা হয়নি।

এমনই এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ বলছে, শিশুশ্রম মোকাবিলায় আমাদের যৌথ অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে শিশুশ্রম নির্মূল করা সম্ভব, যদি মূল কারণগুলোকে সমাধান করা হয়। আমাদের সবার জন্য জনগণের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান আনতে অবদান রাখা এবং এটি আরও দক্ষ এবং সুসংগত পদ্ধতিতে করা জরুরি। শিশুশ্রম হল– সম্ভবত– এ সমস্যাগুলো মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।

Advertisement

আইএলও বলছে, শিশুশ্রমের অবসান হলো সামাজিক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার একটি ভিত্তি, যার মাধ্যমে প্রত্যেক শ্রমিক স্বাধীনভাবে এবং সুযোগের সমতার ভিত্তিতে দাবি করতে পারে, তাদের সম্পদের ন্যায্য অংশ যা তারা তৈরি করতে সাহায্য করেছে।

শিশুশ্রম সম্পর্কিত পরিস্থিতি একাধিক চ্যালেঞ্জ এবং পরিবর্তনের সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার অনুভূত অভাবের প্রতিধ্বনি করে। এটি দারিদ্র্য এবং বর্জন দ্বারা সৃষ্ট এবং স্থায়ী একটি সমস্যা। এটি শিশুদের শিক্ষা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে একটি উপযুক্ত আয় এবং স্থিতিশীল কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার বিরুদ্ধে প্রতিকূলতার সৃষ্টি করে।

এটি এমন একটি অবিচার যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবার এবং পরিবারের স্তরে অনুভূত হয়- শিশুশ্রমের দুই-তৃতীয়াংশ একটি অবদানকারী পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘটে। কিন্তু এটি সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আটকে রাখে এবং বিশ্বের অনেক অংশে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের সাথে যুক্ত হতে পারে। এটি সামাজিক সংহতি এবং মানুষের অগ্রগতির জন্য হুমকিস্বরূপ।

শিশুশ্রম মোকাবিলার ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড এবং সামাজিক সংলাপের ওপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং বাস্তবায়ন, ভালো মানের শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার সর্বজনীন প্রবেশাধিকারের বিধান, সেইসাথে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা দূর করার সরাসরি ব্যবস্থা। এবং প্রাপ্তবয়স্ক কর্মীদের জন্য শোভন কাজের ব্যবস্থা করা।

২০২২ সালে ৫ম বিশ্ব সম্মেলনে গৃহীত ডারবান কল টু অ্যাকশনের শিশুশ্রমের মূল কারণগুলো মোকাবিলা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অগ্রগতির জন্য দৃঢ় পদক্ষেপের প্রচার করা। এটি ইতিবাচক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তুলতে একটি নীলনকশা হিসেবে গৃহীত। এটি নিশ্চিত করতে চায় যে জাতীয় ও বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণ ও কার্যক্রমে, উন্নয়ন সহযোগিতায় এবং আর্থিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তিতে শিশুশ্রম বিরুদ্ধ প্রতিশ্রুতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

সুতরাং, ILO শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের বিশ্ব দিবসকে আমাদের সবার জন্য একটি মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করি যারা শিশুশ্রমের অবসান ঘটাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তা প্রদর্শন করার জন্য যে পরিবর্তনটি অর্জন করা যেতে পারে যখন ইচ্ছা এবং সংকল্প একত্রিত হয় এবং প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটি গতি প্রদান করে। এটি একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থা।

এই বছর বিশ্ব শিশুশ্রমবিরোধী দিবসে আইএলওর আহ্বান, সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে পুনরুজ্জীবিত করা, বিশেষ করে সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য পরিকল্পিত গ্লোবাল কোয়ালিশনের অধীনে শিশুশ্রম নিরসন, কারণ এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

ন্যূনতম বয়সের ওপর আইএলও কনভেনশন নং ১৩৮-এর সর্বজনীন অনুমোদন, যা ২০২০ সালে গৃহীত সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশু শ্রম সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন নং ১৩৮-এর সর্বজনীন অনুমোদনের সাথে সম্পর্কিত সব শিশুকে সব ধরনের শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা প্রদান করবে; এবং ডারবান কল টু অ্যাকশন কার্যকরী বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ন্যায়বিচার হলো ন্যায্যতার একটি মানসিকতা, যা নিশ্চিত করে যে সব মানুষ সময়মতো ও যথাযথ সুযোগ পায় এবং সমান অধিকার ও মর্যাদা অর্জন করে।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রধান কার্যকারিতা নিম্ন লিখিত হতে পারে: বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসন সম্পর্কিত আইন ও বিধান আছে, যা শিশুদের কাজ করার শর্তগুলো নির্ধারণ করে। সামাজিক ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আইনগতভাবে শিশুশ্রমে প্রবেশ প্রতিরোধ সংযোজন করে শিশুদের অধিকার রক্ষা করা যায়।

শিশুদের শিক্ষা ও সচেতনতা জাগৃত করার মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসনের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়। শিশুদের অধিকার জানার কর্মসূচি পরিচালনা করলে তারা নিজেদের অধিকার জানতে পারে এবং নিজেদের সুরক্ষা দিতে পারে।

সামাজিক ন্যায়বিচার জাগৃত করার জন্য সমাজে শিশুশ্রম নিরসনের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এটি সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা ও সংগঠিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সম্প্রদায়ে পরিবর্তন আনা যায়।

শিশুশ্রম নিরসনের জন্য বেসরকারি সামাজিক সংস্থা এবং সরকার একসাথে কাজ করতে হবে। সরকার প্রশিক্ষণ, উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রদান করতে পারে এবং সামাজিক সংস্থা সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে।

এভাবে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমাজের পরিবর্তন শিশুশ্রম নিরসনের জন্য সহায়তা করতে পারে। এটি সমাজের সব সদস্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা শিশুদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

শিশুশ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা, যা শিশুদের উন্নয়ন ও ভবিষ্যতের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। শিশুশ্রমের কারণে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানসিক উন্নয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুশ্রম শিশুদের স্বপ্ন ও আশায় প্রভাব ফেলে, যা তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও সুযোগ হ্রাস করে।

শিশুশ্রমের কারণে শিশুদের শিক্ষালাভের সুযোগ হারিয়ে যায়, যা তাদের সুযোগ সীমিত করে। ফলে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ে, তারা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে এবং উন্নতির প্রত্যাশা সংকোচিত হয়। শিশুরা শিক্ষা, পেশা, কর্মসূচি এবং আর্থিক স্বাধীনতার অভাবে উন্নতির সুযোগ হারায়।

শিশুশ্রম নিবারণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। সরকার এবং সমাজের সব সদস্যকে সহায়তা এবং সহযোগিতা প্রয়োজন যাতে শিশুদের প্রতি সচেতনতা জাগৃত করা যায় এবং শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হয়।

শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করা উচিত, যাতে তারা সঠিকভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারে এবং তাদের ভবিষ্যতের সুযোগ না হারায়। এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে কতজন শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং তাদের মধ্যে কতজন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত তার সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। এর ভিত্তিতে সরকারি শিশুনীতি ও শ্রমনীতি সংশোধন করতে হবে। শিশুশ্রমের বয়সের কঠোর ও বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

২০২৫ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে কৌশল প্রণয়নের জন্য দেশের সব শিশু সংগঠন, আইএলও, ইউনিসেফ এবং বেসরকারি সামাজিক সংগঠন, স্কুল শিক্ষক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা, গণমাধ্যম এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগকে একত্রিত হতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে শিশুশ্রমের ভারে ভেঙে পড়তে পারে উন্নয়নের আর্থ-সামাজিক ভিত্তি।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম