দেশজুড়ে

কৃষকের লাভের গুড় ব্যাপারীর পকেটে!

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের কৃষক আজিজুল হক (৪৮)। তিনি নিজের জমি চাষাবাদের পাশাপাশি অন্যের বাড়িতেও কাজ করেন। ছয় মাস আগে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দুটি ষাঁড় কিনেছিলেন লালনপালন করে কোরবানি ঈদে ভালো দামে বিক্রি করবেন বলে।

ঋণ নিয়ে ষাঁড় কেনায় প্রতি মঙ্গলবার তাকে কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। এদিকে ষাঁড় দুটি মোটাতাজা করতে নিয়মিত গো-খাদ্য কিনতে হতো। ধান কাটার মৌসুমের পর গ্রামে তেমন কাজ না থাকায় তিনি অনেকটাই পড়েছিলেন বিপাকে। পরে স্থানীয় একজনের কাজ থেকে চড়া সুদে আরও ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেই টাকা দিয়ে কিস্তি দিতেন ও গো-খাদ্য কেনেন।

এভাবে ছয় মাস ষাঁড় দুটি লালনপালন করতে তার তিন বিঘা জমির খড়সহ দানাদার খাদ্য ও ভুসিবাবদ ব্যয় হয় আরও দেড় লাখ টাকা। তার প্রতিদিনের পারিশ্রমিক বাদেও দুটি ষাঁড় কেনা থেকে মোট খরচ হয় তিন লাখ টাকা। যার সঙ্গে ঋণের সুদ যুক্ত করলে দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা।

কৃষক আজিজুল হক রোববার (২৫ জুন) রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া হাটে ষাঁড় দুটি বিক্রি করতে নিয়েছিলেন। গরু দুটি ব্যাপারীদের কাছে চার লাখ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

ষাঁড় দুটি বিক্রি করে আজিজুল হক ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা পেলেও তার পারিশ্রমিক বাদে খরচ তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা। এতে তার ৮৫ হাজার টাকা লাভ থাকলেও ছয় মাসের পরিশ্রম বাদ দিলে কিছুই থাকে না বলে তিনি দাবি করেন।

আজিজুল বলেন, ব্যাপারী আমার সামনেই একটি ষাঁড় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং আরেকটি ২ লাখ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করলো। এতে ব্যাপারীর কোনো খরচ ছাড়াই লাভ ৪০ হাজার টাকা। যা আমরা ছয় মাসেও করতে পারি না।

এ হিসাবে শুধু কৃষক আজিজুল হকের ক্ষেত্রেই নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদেরও একই অবস্থা।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মমিন বলেন, কৃষকরা মাসের পর মাস শ্রম দিয়ে স্বপ্নপূরণ তো দূরে থাক, পেটের পীড়ন সামলে টিকে থাকাই যেন অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। আর আমাদের শ্রমে লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা।

ধানগড়া হাটের গরুর ব্যাপারী তুজাম সেখ জাগো নিউজকে বলেন, কোরবানির গরু মূলত মাংসের ওপরে দাম হয় না। দাম হয় পছন্দের ওপরে। আমরা একটু লাভের জন্যই গরু কিনি। অনেক সময় বেশি লাভ হয়, আবারও কখনো কমও হয়।

বিভিন্ন গরুর হাট ঘুরে দেখা যায়, লাখের নিচে গরু মিলছেই না। তবে ক্রেতারা গরুর দাম বেশি বলে দাবি করলেও বিক্রেতারা বলছেন, গো-খাদ্যের দাম অনুযায়ী দাম বেশি না।

তাড়াশ হাটে কথা গরুর ব্যাপারী শাহ জামালের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সারাবছর বেশি গরু কিনি না। কিন্তু কোরবানির ঈদে ১০ জন মিলে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গরু কিনি। তাতে বেশ ভালোই লাভ হয়।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাগবাটী হাটে গরু বিক্রি করা কৃষক মকবুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, গো-খাদ্যের দাম ও শ্রম হিসাব করলে লস। আমি ৮০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছিলাম। চার মাস পর সেটা বিক্রি করলাম দেড় লাখ টাকা। গরুর দামসহ আমার চার মাসে মোট খরচই হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো। সে হিসাবে আমার শ্রমের মূল্য ধরলে কোনো লাভই থাকে না। অথচ ব্যাপারীরা ঠিকই লাভ করবে।

জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, কৃষিপণ্য কৃষকের কাছ থেকে ভোক্তার কাছে যেতে অন্তত তিন দফা হাতবদল হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি লাভ করেন। চাষির পণ্য বিক্রি করে কয়েক গুণ বেশি লাভ করেন এই মধ্যস্বত্বভোগীরা।

রায়গঞ্জ উপজেলার কৃষিবিদ কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সত্যি কথা বলতে কৃষিনীতি তৈরি হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে। গ্রামের গরু চাষিদের মতো লোকের কথা কেউ তেমন চিন্তাই করে না। এভাবে কৃষিখাতের অগ্রগতি টেকসই হবে না। কৃষকের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ার আগেই বড় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, কৃষকদের তুলায় গরুর বাজার সম্পর্কে ব্যাপারীরা ভালো জানার কারণে তারা এমন সুযোগ নিচ্ছেন। সেজন্য তিনি কৃষকদের সর্তক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি জানান, জেলার ৩১টি স্থায়ী ও ১৬টি অস্থায়ী পশুর হাটের মাধ্যমে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৩৯৬টি গবাদিপশু বিক্রি হবে। এর মধ্যে গরু ১ লাখ ৭১ হাজার ৭১২টি, মহিষ ১ হাজার ৪০৫টি, ছাগল ১ লাখ ৫৫ হাজার ও ভেড়া ৬১ হাজার ১৩৩টি। এ জেলায় কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার।

এমআরআর/এএসএম