দেড় হাজারেরও বেশি আগের পুরাকীর্তি ‘ভরত ভায়না বৌদ্ধমন্দির’। যশোরের কেশবপুর উপজেলার ভরত ভায়না গ্রামের এই বৌদ্ধমন্দির ‘ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল’ হিসেবে পরিচিত। ভ্রমণপিপাসুরা এখানে এসে খুঁজে পান মহাস্থানগড় বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের স্বাদ। ঈদের ছুটিতে এই পুরাকীর্তি দর্শনও হতে পারে উৎসব-অনুষঙ্গ।
ভদ্রা নদীর পশ্চিম পাশে কেশবপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম ভরত ভায়না। এই গ্রামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আনুমানিক দেড় হাজার বছরেরও বেশি আগের এক ঐতিহাসিক পুরকীর্তি। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এই মন্দিরে ব্যবহৃত ইট ও প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি গবেষণা করে নিশ্চিত হয়েছেন, এটি খ্রিস্টীয় তিন থেকে ছয় শতকের মধ্যে নির্মিত মন্দির। অনেকটা মহাস্থানগড় বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো দেখতে এই প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনটি স্থানীয়ভাবে ‘ভরতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল’ হিসেবে পরিচিত।
আরও পড়ুন: ঈদের ছুটিতে সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে আসুন 'বাংলার কাশ্মীরে'
যশোরের কেশবপুর সদর থেকে ভরত ভায়না গ্রাম ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। গ্রামটির অবস্থান যশোর জেলায় হলেও খুলনা থেকে সেখানে যাওয়া সহজ। সড়ক পথে যশোরের কেশবপুর হয়ে খুলনার চুকনগর; অথবা খুলনা থেকে চুকনগরে এসে ভ্যান, মোটরসাইকেলে যাওয়া যাবে ভরত ভায়নায়। আবার খুলনার দৌলতপুর থেকে ডুমুরিয়ার শাহপুর বাজারে সড়ক ধরে ভদ্রা নদীর সেতু পার হলে ভরত ভায়না গ্রাম। গ্রামের ইটের সোলিং রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলেই দেউলের চূড়া নজরে পড়বে। দেউল প্রাঙ্গণে আছে বিশাল এক বটগাছ।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ ১৯২২ সালে এই ঢিবি সংরক্ষণ করে। ১৯২৩ সালে কাশিনাথ দীক্ষিত ঢিবিতে জরিপ পরিচালনা করেন এবং মন্তব্য করেন যে ঢিবির নিচে পাঁচ শতকের প্রাচীন একটি বৌদ্ধমন্দির আছে এবং এটি সম্ভবত হিউয়েন-সাং বর্ণিত সমতটের ৩০টি সংঘারামের একটি। সে সময় তিনি কিছু সীমানা পিলারও দেন।
প্রাচীন মন্দিরটি ভরত নামধারী এক প্রভাবশালী রাজা নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত। অনুমিত মূল মন্দিরটি ১ একর ২৯ শতক জমির ওপর অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৫ সালে প্রথম এই ঢিবি খনন করে। এক দশক পর ১৯৯৫-৯৬ সালে পুনরায় এখানে খনন করা হয়। তখন থেকে ১৯৯৬-৯৭ বাদে ২০০০-০১ পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে খননকাজ অব্যাহত ছিল। খননের ফলে একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় যে স্থাপনাটির উপরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: ঈদের ছুটিতে ঘুরে আসুন মিরসরাইয়ের ১০ পর্যটন স্পটে
এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালকের কার্যালয় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের খনন দলের অংশগ্রহণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঢিবির এক-চতুর্থাংশের (উত্তর-পশ্চিমাংশ) স্থাপত্যকাঠামো উন্মোচনের নিমিত্তে খননকাজ সম্পাদিত হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের ভিত্তিতে তিনটি স্থাপত্যিক কালপর্ব পাওয়া গেছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের করা স্কেচ থেকে জানা যায়, মোট ৮২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ ধাপে ধাপে ওপরের দিকে উঠে গেছে। ঢিবির শীর্ষ ধাপটির দেওয়াল ৯ ফুট প্রশস্ত। এর মধ্যে ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থের বর্গাকৃতির চারটি প্রকোষ্ঠ আছে। মূল অট্টালিকার প্রধান কক্ষটি এই প্রকোষ্ঠের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপের দেওয়াল ৩ ফুট চওড়া, এখানে বিভিন্ন আকৃতির ১৯টি প্রকোষ্ঠ আছে। ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া দেওয়ালের তৃতীয় ধাপে প্রকোষ্ঠ ১৮টি। সাড়ে ৩ ফুট চওড়া দেওয়ালের চতুর্থ ধাপটিতে ১৯টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। শেষ ধাপে ১০ থেকে ১৩ ফুট চওড়া দেওয়ালের মধ্যে ২২টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। তার নিচে প্রায় ১০ ফুট চওড়া প্রদক্ষিণ পথ আছে। মূল মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশপথ আছে। এগুলোর মধ্যেও এখন পর্যন্ত সাতটি প্রকোষ্ঠ দেখা গেছে। গঠনশৈলী বিবেচনায় পূর্ব দিকটাই এর মূল প্রবেশপথ ছিল বলে ধারণা করা হয়। এর নির্মাণে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তার পরিমাপ ৩৬ সেন্টিমিটার, ২৬ সেন্টিমিটার ও ৬ সেন্টিমিটার। এত বড় ইট এই অঞ্চলের কোনো পুরাকীর্তিতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি।
বর্তমানের দৃশ্যমান অংশ সম্ভবত বিনষ্ট হওয়া অট্টালিকার ভিত্তি বা উঁচু মঞ্চ। স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও গুপ্তযুগের একটি পোড়ামাটির মাথা, পোড়ামাটির মানুষের হাত ও পায়ের কয়েকটি ভগ্ন টুকরা, কয়েকটি মাটির প্রদীপ, অলংকৃত ইটের টুকরা, পদচিহ্ন-সংবলিত দুটি ইটের টুকরা এবং একটি মাটির ক্ষুদ্র পাত্র সংগ্রহীত হয়েছে, যা খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে। তবে বিভিন্ন সময়ে সুযোগসন্ধানী মানুষ এখান থেকে অনেক মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে।
ভরত ভায়না ঘুরে আসা যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার মারুফ আহমেদ বলেন, ভরত রাজার দেউল অনেকটা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো। এখানে আসলে যেন দেড় হাজার বছর আগের ইতিহাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য এটি ভ্রমণের সুন্দর একটি স্পট।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলি ইয়াসমিন বলেন, ‘ভরত ভায়না বৌদ্ধমন্দির’ আদি ঐতিহাসিক যুগে নির্মিত একটি স্থাপনা। এখানে প্রচুর দর্শনার্থী আসেন। তারা দর্শনীর বিনিময়ে এই পুরকীর্তি পরিদর্শন করেন। এটি রোববার এবং সোমবার সকালে বন্ধ থাকে। এছাড়া সপ্তাহের পাঁচদিন খোলা থাকে।
মিলন রহমান/এমআরআর/আরএইচ/এএসএম