মতামত

ক্রিকেটের বাগানে মাশরাফিদের ফুল ফোটানোর দিন

ইডেন উদ্যান। ক্রিকেটের নন্দন কানন। ঐতিহ্যের বিশালতায় ক্রিকেটের এই ফুলবাগান  তুলনীয় হতে পারে কেবল লর্ডস, মেলবোর্নের সঙ্গেই। কিন্তু ইডেন শুধু ঐতিহ্যের ফ্রেমেই বন্দী নয়। ক্রিকেটের আবেগের জায়গাটিতে  ইডেন একক অধিশ্বরী। সূর্য অস্ত না যাওয়া বৃটিশ রানীর মর্যাদায় আসীন। আর তাই বোধকরি এই অভিজাত ক্রিকেটের মঞ্চে প্রবেশাধিকার ঔপনিবেশিক আমলের রানী দর্শনের মতই দুর্লভ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর গোটা ক্রিকেট দুনিয়া চষে বেড়িয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। কিন্তু ইডেনের ছাড়পত্র মেলেনি। অবশেষে  রানীর ছাড়পত্র মিললো ২৬ বছর পর। ১৯৯০ সালের পর আজই প্রথম ক্রিকেটের নন্দন কাননে খেলার সুযোগ পেল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। কতো হাজারও আনন্দ বেদনার কাব্য রচিত হয়েছে ইডেনে। হয়তোবা হার মানাবে আরব্য উপন্যাসের এক হাজার এক রাত্রির গল্পকেও। হালের ক্রিকেটে আবেগের কেন্দ্রে মাশরাফি মর্তুজার বাংলাদেশ। ইডেনে অভিষেক মাশরাফিদের । শিহরিত ক্রিকেটপ্রেমীরা। ক্রিকেটের ফুলবাগানে মাশরাফিরা ফুল ফোটাবে এই বিশ্বাস এখন  ক্রিকেট দুনিয়া জুড়ে।ধরা যাক বিনোদন জগতের সম্রাট বিগ বি’ খ্যাত অমিতাভ বচ্চনের কথাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে চলচ্চিত্র দুনিয়ার ভীষ্ম পিতার ভাষ্য- ‘বাংলাদেশকে যতো দেখছি ততো মুগ্ধ হচ্ছি। ক্রিকেটের প্রতি কি প্যাশন? দেশকে ভালো না বাসলে বোধকরি এই প্যাশন আসে না। যেন এই খেলার উপর নির্ভর করছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের বাঁচা-মরা। আমি বহুদিন কোনো দেশের ১১ জনের মধ্যে এমন প্যাশন দেখিনি।’ বিগ বি  আজ মাঠে বসেই দেখবেন ক্রিকেটে মাশরাফিদের সৌকর্য, দেশপ্রেম সর্বোপরি আবেগময় ক্রিকেট। ইডেনের উচ্ছ্বাস- আবেগের সঙ্গে  হাল দুনিয়ায় সবচেয়ে ভালো মানায় যে বাংলাদেশ ক্রিকেটকেই।প্রথম সুযোগেই ইডেনে ফুল ফুটিয়েছিল বাংলাদেশ। যদিও তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে বলার মতো কিছু ছিল না। ওয়ানডে, টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার স্বপ্ন তো দূরের ব্যাপার, কোনোদিন বাংলাদেশ আদৌ বিশ্বকাপ খেলতে পারবে কি-না এমন স্বপ্ন দেখাটাও ওই সময় ছিল অনেকটা ঔদ্ধত্যের সামিল।  এমনি সময়ে ১৯৯০ সালে ক্রিকেটের বাগিচাকে নিজের রংয়ে রাঙালেন আতহার আলী খান। তারিখটি ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বড় দলগুলোর সঙ্গে একই মাঠে খেলতে পারাটাই তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য সাত রাজার ধন পাওয়ার মত একটা ব্যাপার। কিন্তু ক্রিকেটের নন্দন কাননে শুধু এটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি ছিলেন না বর্তমানে জনপ্রিয় টিভি ধারাভাষ্যকার আতহার আলী। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই ম্যাচে ৯৫ বলের ইনিংসে ৭৮ রানে অপরাজিত থাকলেন বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডার। হার না মানা মানসিকতার জন্য পেলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। ওই সময় ক্রমশই ক্রিকেটে পরাশক্তি হয়ে ওঠা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের চিন্তা মাথায় নেয়ারই কোনো সুযোগ ছিল না বাংলাদেশের। তবে ক্রিকেট বিশ্বকে একটা বার্তা ঠিকই দিয়ে দিলেন আতহার। আর সেটা শুরু হল ইডেন থেকেই। বলাবাহুল্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটাই বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের প্রথমবারের মত ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার পাওয়ার ঘটনা।আজ প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। ক্রিকেটে পাকিস্তানের অর্জনের বড় অংশ জুড়েই আছে ইডেন। ১৯৮৯ সালের নেহেরু কাপে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত মাঠ ছাড়লো শিরোপা জিতে। ইডেন গার্ডেনসের ফাইনালে ওয়েস্টইন্ডিজের গড়া ২৭৩ রানের চ্যালেঞ্জে শেষ বলের নাটকীয়তায় জিতলো পাকিস্তান। ভিভ রিচার্ডসের করা শেষ ওভারের শেষ বলে ছক্কা মেরে পাকিস্তানকে শিরোপা এনে দিলেন  ওয়াসিম আকরাম। লঙ্কানদের সর্বোচ্চ অর্জনের পথে স্থায়ী হয়ে আছে ইডেনের নামও। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে স্বাগতিক ভারতকে ক্রিকেটের বাগিচায় অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করালো অর্জুনা রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। ঘূর্ণিসর্বস্ব উইকেটে অরবিন্দ ডিসিলভার ৪৬ বলে গড়া ৬৬ রানের ইনিংসটি এখনও অনেকের স্মৃতিতেই জ্বলজ্বলে। ক্রিকেটের নন্দন কাননে ফুল ফোটানো লঙ্কানদের আর ফাইনালে আটকে রাখার সাধ্য ছিলো না অস্ট্রেলিয়ার।ক্রিকেটে আবেগ মরে যাচ্ছে এমন অভিযোগ ওঠে প্রায়শই। ক্রিকেট থেকে প্রায় নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া সেই আবেগ ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। কি এক অবিশ্বাস্য মনোবলে বারবার ডাক্তারদের ছুরি কাচির নিচ থেকে উঠে মাঠে ফিরে আসেন মাশরাফি। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ছোঁয়ায় অন্য অনেক কিছুর মতো বদলে গেছে ক্রিকেটও। যান্দ্রিক একঘেয়ে হয়ে উঠেছে ক্রিকেটও । ঠিক এরকম একটা অবস্থায় বাংলাদেশ ক্রিকেট যেন মরুর বুকে জল।। স্লোয়ার-কাটার দিয়ে  পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ২০ বছরের তরুণ মুস্তাফিজুর রহমান। মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদ যখন ব্যাট করেন মনে হয়, ক্রিকেটে লড়াই শব্দটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে নতুন করে। নিজেকে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা তামিম ইকবালকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। পুরো দলকে একটা বিনি সুতোর মালায় রুপ দিয়েছেন মাশরাফি। এই বাংলাদেশের স্পর্শে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে সবুজ।  এটাই ক্রিকেটের কাছ থেকে ক্রিকেটেপ্রেমীদের চিরন্তন চাওয়া।ধরে নিচ্ছি আজ কমেন্ট্রি বক্সে থাকবেন আতহার আলী। বার বার ঘুরে ফিরে উঠে আসবে ১৯৯০ সালের বছরের শেষ দিনটি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন কুঁড়িও নয়। কিন্তু ইডেনে সেদিন সবাইকে ছাপিয়ে ওঠেন ‘ভয়েচ অব বাংলাদেশ’ খ্যাত আতহার। কিভাবে প্রতিকূলতার সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে উঠে এসছে বাংলাদেশ, এই কথা বলবেন বোদ্ধারা। উঠে আসবে মুলতানের জয় জয় সুবাস ছড়ানো ট্রাজেডি, কার্ডিফের জয় কিংবা লর্ডসে তামিমের সেঞ্চুরি। অনেক কষ্টের পাথর বুকে বেঁধে, চোখের পানি মুছে চরম দুঃসময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পাশে ভক্তরা কিভাবে থেকেছেন  হয়তো সবটা আসবে কিংবা আসবে না। তবে ক্রিকেটের নন্দন কাননে আতহারকে দেখে গত আড়াই দশকের বাংলাদেশের ক্রিকেটের সুখ -দুঃখের  স্মৃতিগুলো ভেসে উঠবে এদেশের কোটি কেটি ক্রিকটেপ্রেমীর মনে। ইডেনে কেন আরেকবার মাঠে নামতে ২৬ বছর লেগে যায়, উপলব্ধি করবেন মুশফিক সাকিবরা? ইডেনের কমেন্ট্রি বক্সে থাকবেন আতহার আর মাঠে ফুল ফোটানোর জন্য আজ নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দেবেন মাশরাফিরা।এইচআর/পিআর