দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাস পাঁচেক। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি মাঠ জমিয়ে রেখেছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের প্রস্তুতি রেখে নিজেদের উন্নয়ন প্রচারে ব্যস্ত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিদেশি কূটনীতিকরাও বেশ সরব। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছেন তারা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্র করে বিদেশিদের বাড়তি আগ্রহ সব সময়ই থাকে। তবে এবার সেটি একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বারবার উঠে আসছে সবার তরফ থেকেই। নির্বাচন সামনে রেখে কূটনীতিকদের তৎপরতা সামনে আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন>> অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভিসানীতি: উজরা জেয়া
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর দেশটির জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে এটি ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। সফরকালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন উজরা।
যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক মানবাধিকার নীতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে জানান উজরা জেয়া। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নির্বাচন ও সুশাসনে ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশির অংশগ্রহণের ওপর বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। একটি অংশগ্রহণমূলক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতা থাকবে, যেখানে সব নাগরিকের বিকাশ হবে।
জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ মূল্যায়ন করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদস্যের নির্বাচনী অনুসন্ধানী মিশন দল বেশ কয়েকদিন অবস্থান শেষে ঢাকা ছেড়েছে। সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল, কূটনীতিকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছে দলটি। ২০১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। এই অনুসন্ধানী মিশন ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেলের কাছে যে মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেবে তার ওপর ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন (ইওএম) পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া সরকারের আমন্ত্রণে ২৪ জুলাই বাংলাদেশ সফরে আসছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর।
আরও পড়ুন>> সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জোরালো পদক্ষেপে আমরা উন্মুখ: উজরা জেয়া
নির্বাচন সামনে রেখে এই ইস্যুতে নিয়মিত প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের ঢাকার দূতাবাস। সম্প্রতি ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ঢাকায় ১২টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতার কোনো স্থান নেই। আমরা পূর্ণ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহির দাবি জানাই। আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় সেজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাই।
ঢাকায় বিদেশি মিশন থেকে দেওয়া যৌথ বিবৃতির পর ক্ষোভ প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, আমাদের অ্যাক্টিভিস্ট ডিপ্লোম্যাট সম্পর্কে বলতে চাই। আমেরিকায় যখন তখন লোক মেরে ফেলে, তারা কি কখনো বিবৃতি দেয়। ইউএন (জাতিসংঘ) কি কোনোদিন বিবৃতি দিয়েছে? বলেছে যে আমেরিকায় লোক মারা যায় কেন? ক্যামব্রিজে একটি বাঙালি ছেলে মারা গেলো ফয়সাল, তারা কি বলেছে ছেলের তদন্ত কতদূর হয়েছে। কিংবা রাষ্ট্রদূতরা কি দলবেঁধে কোনো বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাস করেন না কেন? প্রতিদিন লোক মারা যায় বিভিন্ন দেশে। তখন তারা কেন স্টেটমেন্ট দেয় না। আর বাংলাদেশ হলেই… একটা মগের মুল্লুক পাইছে ওরা।
আরও পড়ুন>> সংলাপ নিয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না যুক্তরাষ্ট্র: উজরা জেয়া
নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপকে কেউ ইতিবাচকভাবে দেখলেও কেউ মনে করছেন এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। কেউ নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানে গুরুত্ব দিলেও কারও মতে বন্ধুরাষ্ট্র প্রয়োজনে পরামর্শ দিতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এ কে এম আতিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে আমি তাদের (অন্য দেশের) অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামাতাম না। মালয়েশিয়ায় আমি রাষ্ট্রদূত থাকাকালে ওদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ব্রিফ করছিলেন নির্বাচন সম্পর্কে আমি বললাম আমরা কি তোমাদের নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখতে পারি যে কীভাবে কী হয়, তাহলে দেখতাম এগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে কাজে লাগে কি না। তখন তারা বলেছে আমরা কাউকে আমাদের পোলিং স্টেশনে অ্যালাউ করি না। তারা আমাকে বলেছে, তুমি রাস্তা দিয়ে দেখতে পারো, কিন্তু তুমি কেন্দ্রে ঢুকতে পারবে না।'
‘এই হলো ওদের সোজা কথা। আর ওদের রাজনীতি সম্পর্কে কখনো কোনো মন্তব্য বা বিবৃতি দেওয়া, সমালোচনা করার মতো ঘটনা ঘটেনি। এটি আমি কোনো দেশেই দেখিনি। এ চেষ্টা আমি নিজেও করিনি, কাউকে করতেও দেখিনি।’
আরও পড়ুন>> নিরপেক্ষতা নিশ্চিত না হলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুফল কেউ পাবে না
তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু দোষ আছে। আমাদের দোষেই ওরা (বিদেশি) এই সাহসটি পাচ্ছে। আমরা কিছু হলেই দৌড় দেই ওদের কাছে। কেন দৌড় দেবো। ওরা কি আমাদের প্রভু, নাকি আমাদের দেশের মালিক? আমাদের দেশের মালিক জনগণ। রাজনীতিবিদরা দেশটাকে এভাবে ধ্বংস করে ফেলছে, আমাদের মান-সম্মান কিছুই রাখছে না।
‘আগে নিজেরা নিজেদের সমস্যা মেটাক, বিদেশিদের দিয়ে যেন সেটি না করান। তাদের কাছে জবাবদিহি না করলে আমাদের কিছু যায় আসে না। গণমাধ্যমকে বলবো তাদের বিবৃতি আপনারাও ছাপাবেন না। আমাদের ইন্টারনাল ব্যাপারে মান-সম্মান হানি হয় এ ধরনের কোনো জিনিস ছাপাবেন না। আমরা নিজের ঘরের কথাটাই ওদের কাছে গিয়ে বলি।’
সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মোফাজ্জল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্ধুরাষ্ট্র এক বন্ধুর খুব জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করতে পারে। আমার বাড়িতে জরুরি কিছু হলে প্রতিবেশীর সঙ্গে যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে নিশ্চয়ই সে উৎসাহ দিতে পারে, স্বপ্রণোদিতভাবে কোনো মতামত দিতে পারে। যার বাড়িতে আসবে তিনি নিজেও তাদের কাছে পরামর্শ চাইতে পারেন। এই উপমাটা দেওয়ার কারণ হলো যারা মন্তব্য করছেন তারা সবাই আমাদের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র। এমন নয় যে ইসরায়েল এটিতে মন্তব্য করছে, যাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই বা কোনো সম্পর্কই নেই।’
আরও পড়ুন>> ইইউ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াত
‘কোনো পরাশক্তি যখন দেখে তাদের কোনো বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রের জরুরি সময় সামনে এসেছে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন; যে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ইতিহাস ভালো নয়, তখন তারা নিশ্চয় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করবে বা স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু পরামর্শ দেবে। এটা আমি খুব খারাপ কিছু মনে করি না। বরং মনে করি এটি একটি গঠনমূলক উদ্যোগ বটে। এবং এখান থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’
তিনি বলেন, যেসব দেশে ভোটকেন্দ্রে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না বা হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হয় না তাদের নির্বাচন কতটুকু ত্রুটিপূর্ণ, কতটুকু অসম্পূর্ণ বা গণতন্ত্রবিরোধী ছিল আমি জানি না। কিন্তু আমাদের গত ১০ বছরের যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো খুবই বিশৃঙ্খলাপূর্ণ, খুবই প্রশ্নবোধক ছিল। কিছুতেই বলা যায় না যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে।
মোফাজ্জল করিম আরও বলেন, আগামী বছর জানুয়ারিতে আমাদের দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। একই বছর প্রতিবেশী রাষ্ট্র যাদের বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রিক দেশ, সেখানেও তো নির্বাচন হবে, কই তাদের বেলায় তো এভাবে বলা হয় না। তাদের যে অতীত ইতিহাস আর আমাদের ইতিহাস একই রকম। রাজনীতির কারণে সাধারণ মানুষ, যারা রাজনীতিতে আগ্রহী না তাদের জীবনে যেন দুর্যোগ নেমে না আসে।
আইএইচআর/এএসএ/জিকেএস