কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় সুতি নদীর পশ্চিম প্রান্তে ৮ দশমিক ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধের প্রস্তাব জমা হয়েছে। আর এই বাঁধ নির্মাণ হলে বিপাকে পড়বে হাওর এলাকার কৃষক, শ্রমিক ও জেলেরা। তাই প্রস্তাবিত এ বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ৯ গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, জেলেরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ পালন করেছে।
বুধবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে উপজেলার রাউতি ইউনিয়নে মৌগাঁও গ্রামে নামা হাওরের সামনে তারা এ মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার শিমুলহাটি ঈদগাহ ব্রিজের উত্তর পাশ থেকে সুতি নদীর পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে দাউদপুর আবাসন প্রকল্প পর্যন্ত ৮ দশমিক ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধের প্রস্তাব জমা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এই প্রস্তাবিত প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেটিভ এজেন্সি (জাইকার) তদারকি করবে।
স্থানীয় কৃষক ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাড়াইল উপজেলার বৃহত্তম শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত ‘নামার হাওর’। শিমুলহাটি গ্রামে সুতি নদী খননের আগে এক ফসল হতো এই নামার হাওরে। নদীটি খননের পর নামার হাওরের হাজার হাজার একর জমিতে দুই থেকে তিন ফসল ফলাতে পারছে কৃষকেরা। নদীটি খননের পর থেকে এ হাওরাঞ্চলে স্থায়ী কোনো জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না। তাই তারা সহজে চাষাবাদ করতে পারছে। এছাড়াও জেলেরা নদী ও হাওর থেকে মাঝও ধরতে পারছে।
আরও পড়ুন: কাপ্তাই হ্রদে পানি বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে
রাউতি ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ডের ৯টি গ্রামের বিশাল হাওরে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বাস করেন। এই নামার হাওরকে ঘিরেই তাদের সব স্বপ্ন। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, বর্গাচাষি, মৌসুমি জেলে। এ হাওরে প্রকৃত জমির মালিক রয়েছে প্রায় ৩ হাজার। সম্প্রতি একটি প্রভাবশালী মহল বেড়িবাঁধ ও মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ভূমি অধিগ্রহণ, জাতীয় পানি নীতিমালা ও নদী রক্ষা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সদ্য খনন করা সুতি নদীর তীর ঘেঁষে বাঁধটি হলে, নদী তার পানি প্রবাহ হারাবে। এই নামার হাওরে সেচ ও নিষ্কাশনে কোনো ফসলি জমি রক্ষা বাধের কোনো প্রয়োজন নেই, সেখানে কৃত্রিম জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে বৃহত্তর হাওরের ফসলি হাওর বিনষ্ট করা মানে কৃষক, জেলে হত্যা, নদী হত্যার নামান্তর।
জেলে আসামুদ্দিন জানান, আমরা এই হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। এই বাঁধ নির্মাণ হলে হাওরের পানি থাকবে না। এটি আমাদের মরণফাঁদ। আমদের না খেয়ে মরতে হবে।
কৃষক জাহাঙ্গীর হাসান ভূঁইয়া বলেন, কার স্বার্থে ও কীভাবে এ বেড়িবাঁধ করা হচ্ছে আমরা জানি না। বেড়িবাঁধ হলে আমাদের না খেয়ে মরে যেতে হবে। প্রয়োজনে রক্ত দিব কিন্তু বেড়িবাঁধ হতে দেব না।
প্রতিবাদ সমাবেশে কৃষক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশাল এ হাওরে ৩০ হাজার একর ফসলি জমি রয়েছে। এখানে অদ্যাবধি দুটি ফসল হচ্ছে। কারণ জাইকা ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সুতি নদী খনন করেছে। এখন যদি ৮ দশমিক ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধ হয়, তাহলে কৃত্রিম জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। যারা নিজেদের ফায়দার জন্য বেড়িবাঁধ ও মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প করবে তারা আমাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করাবে।
জেলা কৃষক লীগের সভাপতি আহমেদ উল্লাহ বলেন, প্রস্তাবিত বাঁধ বাস্তবায়ন হলে এই এলাকার কয়েক হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এলাকায় নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে।
আরও পড়ুন: ‘সন্তানদের খাবার দিতে পারছি না, গবাদিপশুগুলোও অভুক্ত’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, প্রকল্পটি আমাদের না। অন্য কোনো সংস্থা কাজটি করছে।
কিশোরগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশ ও ইউনিয়ন পরিষদের রেজুলেশন দিয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে জাইকা থেকে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি ফিজিবিলিটি রিপোর্ট প্রাপ্তির পর প্রকল্পটি জনগণের উপকারে আসবে, বিধায় এটি গ্রহণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রকল্প বাতিলের দাবিতে তাদের আবেদন আমি পেয়েছি। আবেদনের যৌক্তিকতা কি, তা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি।
এসকে রাসেল/জেএস/এমএস