দেশজুড়ে

অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য ট্রেনের কামরা হয়ে উঠল ‘অপারেশন থিয়েটার’

ঢাকা থেকে ট্রেনে করে দিনাজপুরে ফিরছিলেন অন্তঃসত্ত্বা এক নারী। পথেই হঠাৎ শুরু হয় তার প্রসব ব্যথা। দিশাহারা স্বামী কোন উপায় না পেয়ে ফোন দিলেন ৯৯৯ এ। এরই মধ্যে ট্রেনে থাকা যুবকরা খবর পৌঁছে দিলেন টিটির কাছে। ট্রেন কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক-নার্সের সহায়তা চেয়ে দ্রুত মাইকে ঘোষণা দিলেন। মাইকের ঘোষণা শুনেই অন্য কামরা থেকে ছুটে আসেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

শুধু তাই নয় সহযোগীতা করেছেন ট্রেনে থাকা যাত্রীরাও। সবাই নিজ ইচ্ছেতে ওই কামরা ছেড়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের ‘ঘ’ কামরাটি হয়ে উঠল ‘অপারেশন থিয়েটার’। আর সেখানেই চার মাসের মৃত সন্তান প্রসব করে প্রাণে বেঁচে গেলেন ওই নারী।

রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকা থেকে নীলফামারীর চিলাহাটিগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে এ ঘটনাটি ঘটে। সোমবার দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ৪ নম্বর বেতদিঘি ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে নবজাতকের দাফনের সময় খবরটি জানাজানি হয়।

সন্তান প্রসবকারী ওই গৃহবধূর নাম মৌসুমি আক্তার (২৭)। তিনি দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার ৪ নম্বর বেতদিঘি ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের রবিউল আউয়ালের স্ত্রী।

আরও পড়ুন: কানে শুনতে না পাওয়াই কাল হলো রহিমার

ওই রাতে ট্রেনটিতে দায়িত্ব থাকা রেলওয়ের পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী ও প্রসূতির স্বামী রবিউল আউয়াল জানান, রোববার রাত ৮টার দিকে চিলাহাটি এক্সপ্রেসের ‘ঘ’ বগিতে অন্তঃসত্ত্বা মৌসুমি আক্তার অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবরটি জানার পর কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এরপর ট্রেনের মাইকে বিষয়টি জানিয়ে চিকিৎসক ও নার্সের সাহায্য চাওয়া হয়। ঘোষণা শুনেই দ্রুতই সব ঘটতে থাকে। ট্রেনের ‘জ’ বগি থেকে ছুটে আসেন ঢাকার ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহ। ‘চ’ বগি থেকে আসেন রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী আফসানা ইসলাম ওরফে রোজা। একই সঙ্গে দুজন নার্সও সেখানে উপস্থিত হন। চিকিৎসক সানাউল্লাহ ওই নারীর অবস্থা দেখে জরুরি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সিদ্ধান্ত হয় টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করলেন এক যাত্রী। এর মধ্যে ক্রসিংয়ে আটকা পড়ে যায় ট্রেনটি।

এদিকে অন্তঃসত্ত্বা ওই নারীর রক্তপাত থামছিল না। তখন দ্রুত ওই নারীকে ঘিরে ফেলার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। ট্রেনে থাকা নারী যাত্রীরা কাপড় দিয়ে ওই নারীকে ঘিরে ফেলেন। অন্য যাত্রীরা তাদের ব্যাগ থেকে কাপড়, স্যালাইন, হেক্সিসলসহ যার কাছে যা ছিল বের করে দেন।

আমিরুল হক জাহেদী বলেন, মুহূর্তেই ট্রেনটি পরিণত হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটারে। চিকিৎসক সানাউল্লাহর পরামর্শে সঙ্গে থাকা শিক্ষানবিশ নারী চিকিৎসক ও দুজন নার্স কাজ করতে থাকেন। এরপর দীর্ঘ চেষ্টায় ওই নারী মৃত সন্তান প্রসব করেন। তবে ওই নারী আশঙ্কামুক্ত বলে চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহ ঘোষণা করলে পুরো ট্রেনের যাত্রীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

আরও পড়ুন: ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেলো পাটবোঝাই ট্রাক

তিনি বলেন, সবকিছু ভালোভাবে হলেও জরুরি কিছু ওষুধের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাৎক্ষণিক ওষুধ কেনার জন্য যাত্রীরা টাকা তুলতে শুরু করেন। ট্রেনটি তখনো ঈশ্বরদীর কাছাকাছি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ওষুধ কীভাবে জোগাড় করা যায়, এ নিয়ে আবার দুশ্চিন্তা পড়ে যায় সবাই। পরে আমি ঈশ্বরদী স্টেশনের টিটিই আবদুল আলীমকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। আবদুল আলীম ওষুধ কিনে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনে পাঠান। এরপর সেখানে ট্রেন থামলে ওই নারীকে ওষুধ সেবন করানো হয়। ধীরে ধীরে অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ ট্রেনটি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী স্টেশনে পৌঁছায়। স্বামীর সঙ্গে এই স্টেশনেই নেমে যান মৌসুমি আক্তার।

টিটিই আমিরুল হক আরও বলেন, চাকরিজীবনে ট্রেনের মধ্যে বেশকিছু মানবিক ঘটনা দেখেছি। তবে এই ঘটনা অভূতপূর্ব। ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যরা যেভাবে এগিয়ে এলেন, সারারাত ওই নারী পাশে বসে থাকলেন, যাত্রীরা কামরাটি ফাঁকা করে দিলেন, এটি সত্যিই প্রশংসনীয়।

ঘটনার পর টিটিই আমিরুল হক চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহসহ তার সঙ্গে সহযোগিতা করা নার্সদের সঙ্গে কথা বলেছি। দুজন চিকিৎসক ছাড়াও বেশ কয়েকজন নার্স সেখানে ছিলেন। তারা হলেন-ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন ও রুমি ইসলাম।

আরও পড়ুন: ট্রেনের ছাদ থেকে লাফ, গাছের সঙ্গে ধাক্কায় যুবকের মৃত্যু

রবিউল ইসলাম-মৌসুমি আক্তার দম্পতি বলেন, সন্তানের মৃত্যুর খবর জেনেই আমরা ট্রেনে উঠেছিলাম। কিন্তু ট্রেনেই প্রসব ব্যথা উঠবে আমরা তা ভাবতে পারিনি। আমাদের প্রথম সন্তান বেঁচে নেই, কিন্তু ট্রেনের টিটিই, ডাক্তার, নার্স, যাত্রী এবং ট্রেনের স্টাফরা যে সহযোগীতা ও সেবা দিয়েছে তা আমরা কোনদিনও ভুলতে পারব না। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

রবিউল ইসলাম বলেন, সন্তান তো আগেই বিদায় নিয়েছে, স্ত্রীকেও হারাতাম যদি না তাদের সহযোগীতা পেতাম। প্রত্যেকটি ট্রেনে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধের ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমারা চিকিৎসক, নার্স সব পেয়েছিলাম কিন্তু ওষুধ পাচ্ছিলাম না। যদি প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয় তাহলে আমাদের মতো অনেক মানুষ ট্রেনেই সেবা পাবেন।

এমদাদুল হক মিলন/জেএস/এএসএম