ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন ভেঙে ফেলা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ইতিমধ্যেই ভবন ভেঙে ফেলা সংক্রান্ত একটি চিঠি হাসপাতাল পরিচালকের কাছে পৌঁছেছে। দুই হাজার ৪শ’ বেডের বাংলাদেশের সবচয়ে বড় এ হাসপাতালটি কেন ভেঙে ফেলা হচ্ছে, এত বড় হাসপাতালটি ভেঙে ফেলা হলে হাজার হাজার রোগী কোথায় যাবে কিভাবে তাদের চিকিৎসা হবে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন থাকলেও ভবন যে ভেঙে ফেলা হচ্ছে এটা শতভাগ নিশ্চিত। জানা গেছে, ঐহিত্যবাহী এ ভবনটি ভেঙে সেখানে বিশ্বমানের আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গড়ে তোলার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ ভবন ভাঙার কাজ শুরু হবে সে ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।ঢামেক হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. খাজা আবদুল গফুর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি হাসপাতাল পরিচালক ব্রি. জেনারেল ডা.মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-১ ভবনটি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। শতাধিক বছরের পুরোনো হাসপাতাল ভবনের অধিকাংশই ইটের দেয়াল দ্বারা নির্মিত। ভবনের বহু স্থানে ছাদ তৈরি করা হয়েছে রেললাইনের স্লিপার দিয়ে।রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধির ফলে পুরোনো রেল লাইনের স্লিপার দিয়ে ছাদের উপর বহু স্থানে সম্প্রসারণ কাজ করা হয়েছে। ফলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে সুচিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থল এ প্রতিষ্ঠানটির ভবন ভেঙে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র জানায়, ২০১০ সালে তৎকালীন হাসপাতাল পরিচালক ব্রি. জেনারেল শহিদুল হক মল্লিক গণপূর্ত বিভাগকে দেয়া এক চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত কিনা তা সরেজমিন পরিদর্শন ও জরিপ করতে অনুরোধ করেন। প্রয়োজনে ভবনের আংশিক ভেঙে বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধে সক্ষম বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায় কি না সে ব্যাপারে খসড়া কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যাপারে জানতে চান। পরে জরিপ শুরু হলেও ভবনের কোন অংশ এখনও ভাঙা হয়নি।চলতি বছরের ৩ মার্চ ভোরে রাজধানীসহ সারাদেশে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এ ঘটনায় নতুন করে সরকারি হাসপাতালে ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা প্রদানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। প্রথমেই অন্যতম বৃহৎ ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসা সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা হয়।ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মেগাসিটি ঢাকার অধিকাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। দেশে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে হাজার হাজার লোক হতাহত হবে। তাদের জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।হাসপাতালের ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৯০৪ সালে তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল ও আসামের সচিবালয় ভবন হিসেবে নির্মিত হয় বর্তমান ঢামেক হাসপাতাল ভবন। পরে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় হাসপাতাল ভবনের একটি বড় অংশ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বাকি অংশ শিক্ষার্থীদের ডরমেটরি ও কলা ভবনের প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়।পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ ভবনে একশ শয্যার আমেরিকান বেইজড হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে ভবনটিতে ঢামেক প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে মেডিকেল কলেজ পার্শ্ববর্তী ভবনে স্থানান্তরিত হলে এখানে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়।বর্তমানে ঢামেক হাসপাতাল-১, ঢামেক হাসপাতাল-২ ও ঢামেক বার্ন ইউনিট মিলিয়ে ২৬শ’ বেডের হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে আউটডোরে তিন থেকে চার হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।হাসপাতালের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, শতাব্দী পুরানো এই ভবনের নির্মাণকালে সিমেন্ট ব্যবহারের প্রচলন ছিল না। ইট-সুরকির সঙ্গে চুন মিশিয়ে দেয়াল আস্তর করা হতো। এখনকার মতো তখন ছাদ ঢালাইয়ে উন্নতমানের রড ব্যবহার করা হতো না। তখন রেললাইনের স্লিপার বসিয়ে ছাদ নির্মিত হতো।তারা বলেন, খালি চোখে হয়তো ভবনটির ত্রুটি ধরা পড়বে না। কিন্তু বিভিন্ন সময় অপরিকল্পিত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণে তা ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে উঠেছে।সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনটির নির্মাণ পদ্ধতি বর্তমান সময়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিন তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের ছাদ অনেক উপরে। কোন কোন ওয়ার্ডে লোহার স্লিপারের অংশ বিশেষ চোখে পড়ে। অনেক উঁচুতে রড ঝুলিয়ে ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান ইট, সুরকি ও চুন দ্বারা নির্মিত ভবনটিতে বিভিন্ন সময় সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। ফলে খালি চোখে মূল স্থাপনা দেখা যায় না।এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি প্রাপ্তি ও এ সংক্রান্ত পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে হাসপাতাল পরিচালকের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ ও ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমইউ/এমএমজেড/এএইচ/পিআর