দেশজুড়ে

আজিজুল হক কলেজে পরিবহন খাতে হরিলুট

<> করোনায় বাস না চললেও ৫৫ লাখ টাকা উত্তোলন<> নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন সেবা থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা

সরকারি আজিজুল হক কলেজে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরিবহন খাতে বাধ্যতামূলক কোটি কোটি টাকা আদায় করে হরিলুট করা হয়েছে। বিগত ছয় বছরের তথ্যে উঠে এসেছে দুর্নীতির এ চিত্র। অথচ নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহজাহান আলী ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি যোগদান করার পর তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত আরবি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুর রশিদকে পরিবহন কমিটির আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব দেন। এরপর ২০১৮ সালের শুরু থেকে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে কলেজের বাস তহবিল থেকে দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের আজিজুল হক কলেজ শাখার ‘বাস তহবিল’ হিসাব থেকে ২০১৮ সালে ৪০ লাখ, ২০১৯ সালে ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার, ২০২০ সালে ৩৫ লাখ, ২০২১ সালে ২০ লাখ, ২০২২ সালে ২৪ লাখ ২৪ হাজার এবং ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৪৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়লেও আজিজুল হক কলেজের বাস তহবিলের টাকা উত্তোলন বন্ধ ছিল না। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে করোনার আগ্রাসন শুরু হয়। সরকারি সিদ্ধান্তে একই বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিকল্প হিসেবে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রম টানা প্রায় ১৮ মাস অব্যাহত ছিল। এ সময়ে কলেজের বাসগুলো গ্যারেজে বন্দী অবস্থায় পড়ে থাকলেও ওই বছরে ৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। ২০২১ সালেও ২০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।

বাস পুরোপুরি বন্ধ থাকার পরও করোনাকালীন ২০২০ সালের মার্চে ছয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা, এপ্রিলে চার লাখ ৬৭ হাজার, মে মাসে তিন লাখ ২৩ হাজার, জুনে দুই লাখ ২১ হাজার, জুলাইয়ে এক লাখ ৯ হাজার, আগস্টে এক লাখ ৩৭ হাজার, সেপ্টেম্বরে এক লাখ ২০ হাজার, অক্টোবরে তিন লাখ ৩ হাজার, নভেম্বরে এক লাখ ৯৫ হাজার ও ডিসেম্বরে তিন লাখ ৩৬ হাজার টাকা তোলা হয়।

কলেজ সূত্র জানায়, কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ছয়টি বাস রয়েছে। এজন্য প্রতি শিক্ষার্থীর কাছে থেকে বছরে বাধ্যতামূলক ২৭৫ টাকা করে আদায় করা হয়। এ হিসেবে (২৭ হাজার শিক্ষার্থী) বছরে আদায় হয় ৭৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এদিকে বছরে সরকারি নির্ধারিত ছুটি রয়েছে ৮৩ দিন। সাপ্তাহিক শুক্রবার ও শনিবার ছুটির সংখ্যা দাঁড়ায় বছরে ১০৪ দিনে। বিভিন্ন পরীক্ষার কারণে ক্লাস বন্ধ থাকে ৪৫-৫০ দিন। অন্যান্য কারণে ছুটি থাকে ৫-১০ দিন। সবকিছু বাদ দিয়ে বছরে ১২৫-১৩০ দিন শিক্ষার্থীদের পরিবহন সেবা দেওয়া হয়।

বর্তমানে বাসগুলো সারিয়াকান্দি, মোকামতলা, নন্দীগ্রাম, দুপচাচিয়া, শেরপুর ও নামুজা রোডে চলাচল করে। তবে চেলোপাড়া এলাকায় করতোয়া নদীর ওপরে সড়কে সেতু নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় সারিয়াকান্দি রুটের গাড়ি চলাচল অনেকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। আজিজুল হক কলেজ থেকে এ রুটগুলোর গড় দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। সেক্ষেত্রে আসা-যাওয়া মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ কিলোমিটার পথ চলাচল করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাসচালক বলেন, তিন কিলোমিটার বাস চলতে এক লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে সর্বোচ্চ ৫০ কিলোমিটার পথ চলতে ১৬ লিটার তেলের প্রয়োজন হবে। ছয়টি বাসে একই পরিমাণ তেল হিসেব করলে তেল লাগে ৯৬ লিটার। বর্তমান ১০৯ টাকা দাম হিসেবে এর দাম আসে ১০ হাজার ৪৬৪ টাকা লাগে। ১৩০ দিনের পরিবহন তেল খরচ লাগার কথা ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সার্ভিসিং ও মবিল বাবদ ছয়টি গাড়িতে আরও ছয় লাখ টাকা ধরলেও বছরে মোট ব্যয় ১৯ লাখের বেশি হওয়ার কথা নয়। সেক্ষেত্রে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর ব্যয়ের ঘটনাটি হরিলুটের পর্যায়ে পড়ে।

এ বিষয়ে সারিয়াকান্দি দেবডাঙ্গার শিক্ষার্থী আজাদুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার সময় আমরা বাসে না চললেও বাসের ফি জমা দিয়েছি। এর বাইরে বছর বছর ধরে আমরা বাসের টাকা দিই। কিন্তু বাসই আমাদের রুটে ঠিকমতো আসে না। বন্ধ থাকার নোটিশও দেওয়া হয়নি। বাসের আশায় বসে থেকে বাড়ি ফিরে যাই। এ বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু জানতে চাইলেও তারা তথ্য না দিয়ে উল্টো বকাবকি করে।’

কলেজ সূত্র জানায়, পরিবহন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক শাহজাহান আলীকে ২২ অক্টোবর এক আদেশে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। তাকে ৫ নভেম্বরের মধ্যে অধিদপ্তরে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি ৫ নভেম্বর বিকেলে আজিজুল কলেজ থেকে রিলিজ নেন। কিন্তু রিলিজের পরও বাস ফান্ড থেকে তার সইয়ে চারটি চেকের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা হয়, যা সরকারি বিধিবহির্ভূত। এরমধ্যে ৯ নভেম্বর এক লাখ ৭৪ হাজার ৩৮৪, ১২ নভেম্বর তিনটি চেকে ১৪ হাজার ৪০০, ১১ হাজার ৮৯৭ এবং ১৬ হাজার ৯২১ টাকা।

অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে বাস কমিটির আহ্বায়ক আরবি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের বারবার চেষ্টা করেও দেখা মেলেনি। অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

তবে সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহজাহান আলী বলেন, করোনার সময় বাস না চললেও গাড়ি মেরামত ও সার্ভিসিং করতে হয়েছে। এ কারণে ওই সময় ব্যাংক থেকে উল্লেখিত পরিমাণ টাকা তোলা হয়। তবে কলেজের ছাত্র ও টাকা আদায়ের সঠিক পরিমাণ জানা নেই। তিনি দাবি করেন, তার সময়ে বাস ফান্ড থেকে সবচেয়ে কম টাকা ব্যয় করা হয়েছে। দায়িত্ব হস্তান্তরের সময়ও ফান্ডে অনেক টাকা রেখে গেছেন।

এসআর/জিকেএস