লিটন ও আনজু আরা বেগম দম্পতির দুই সন্তানের মধ্যে ছোট সাগরিকা। তার দুই বছরের বড় ছেলের নাম সাগর। মেয়ের ঘরে প্রথম সন্তান, ছেলের নাম সাগর রেখেছিলেন তার নানি। ভাইয়ের নামের সঙ্গে মিল রেখেই সাগরিকার নাম রেখেছিলেন তার ফুফা।
দুই সন্তানের এই নাম রাখার গল্প আজ (বৃহস্পতিবার) কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে বসে বলছিলেন নারী অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ফুটবলার সাগরিকার বাবা-মা।
উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সাগরিকার বাবা-মা এসেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের ফাইনাল দেখতে। প্রায় ২২ কিলোমিটার হেঁটে পীরগঞ্জ উপজেলা স্টেশন থেকে ঢাকার ট্রেন ধরেছিলেন তারা। ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছানোর কারণে আসন পাননি, পুরো পথ দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেষের দিকে অন্য যাত্রীর চালের বস্তার ওপর স্ত্রীকে বসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন লিটন।
মেয়ের খেলা দেখতে ঢাকায় আসলেও সেটা গোপন রেখেছেন তারা। প্রেসবক্সে বসে সাগরিকার বাবা-মা বলছিলেন, ‘আমরা এসেছি তা জানতে পারলে মেয়ের খেলার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আমার ছেলেকেও বলে আসিনি। রাস্তা থেকে ফোনে ছেলেকে জানিয়েছি ফাইনাল দেখতে যাচ্ছি।’
নেপালের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছেন সাগরিকা। জয়সূচক গোল করেছেন ভারতের বিপক্ষে। নিজেদের চায়ের দোকানে ধার করা টিভিতে মেয়ের খেলা দেখেছিলেন সাগরিকার বাবা-মা। ওসই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় ওয়ালটন একটি টেলিভিশনও উপহার দিয়েছে তাদের।
‘এক সময় এলাকার মানুষ সাগরিকার ফুটবল খেলা নিয়ে টিপ্পনি কাটতো। নানা কথা শোনাতে। মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে বলতো পাড়াপড়শিরা। সাগরিকা যখন প্রথম লিগ খেলতে ঢাকায় আসে তখন এলাকার মানুষ রটিয়ে দিয়েছিল, মেয়ে কোনো এক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। তখন সাগরিকার মা তাদের বলেছিলেন-আমার মেয়ে লিগ খেলতে গেছে। টাচ মোবাইলে দেখতে পারবেন’-বলছিলেন সাগরিকার বাবা।
এখন এলাকার মানুষরা কী বলছেন? জবাবে সাগরিকার বাবা বলেন, ‘এখন সবাই খুশি। জোড়া গোল করার পর আমার মেয়ের ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে তা নিয়ে এলাকায় হৈ -হুল্লোড় পড়ে যায়। অনেকে পেপার কিনে এনে সবাইকে দেখায়। আজ আমরা ঢাকায় চলে এসেছি। তবে আমাদের চায়ের দোকানে বড় পর্দায় খেলার দেখার প্রস্তুতি চলছে। খাওয়া-দাওয়াও হবে।’
আপনারা তো মেয়েকে খেলতে দিতে চাননি। কেন? ‘ওই যে সবাই নানা কথা বলছিলো। মেয়ে গত বছর বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিল। আবার ফিরে আসে গ্রামে। সাগরিকা ঘরে ফিরে আমাদের বলেছিলো আমি সরাসরি জাতীয় দলে খেলে তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করবো। তারপরও আমি মেয়ের সঙ্গে এক মাস কোনো কথা বলিনি। মেয়ে যখন সিঙ্গাপুর যাবে, তখন ফোনে আমাকে বলেছিলো-খেলতে সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। দোয়া করিও। কবে ফিরি বা না ফিরি। সেদিন থেকেই আমার অভিমান ভাঙে। এই টুর্নামেন্টের আগে মেয়ে আমার কাছে এক জোড়া বুট আবদার করেছিল ৪ হাজার টাকা দামের। বলেছিলাম আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু দিতে পারিনি। মেয়ে পড়ে বলেছিল, এমনি চেয়েছিলাম।’
কী প্রত্যাশা নিয়ে ফাইনাল দেখতে এত কষ্ট করে ঢাকায় এসেছেন? জবাবে সাগরিকার মা বললেন, ‘আশা করছি, আজও সে গোল করবে এবং বাংলাদেশ জিতবে। সেটা দেখতেই ঢাকায় এসেছি।’
খেলার পর মেয়ের সঙ্গে দেখা করবেন নিশ্চয়ই? ‘জানি না দেখা হবে কিনা। রাতেই ফিরে যাবো। ফাইনালের পর পরিস্থিতি কেমন হবে তার ওপর নির্ভর করবে মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে কিনা’-বলেন সাগরিকার মা।
আরআই/এমএমআর/জিকেএস