বগুড়া শহরের একটি বস্তিতে ও শাজাহানপুরে গুচ্ছগ্রামে আগুনে তিনটি পরিবারের জমানো পুঁজি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
সোমবার (১১ মার্চ) দুপুরে শহরের চেলোপাড়া শিমুলতলী বস্তি ও শাজাহানপুর উপজেলার ডোমনপুকুর গুচ্ছগ্রামে এক ঘণ্টার ব্যবধানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এ দুই ঘটনায় কেউ আহত হননি। তবে ২৪টি পরিবারের ঘর পুড়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, দুপুর ১২টার দিকে রেললাইনের পাশে শহরের চেলোপাড়া শিমুলতলা বস্তিতে আগুন লাগে। এতে ১৪টি পরিবারের ঘর পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট প্রায় ৪০ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনের সূত্রপাতের সময় বস্তির বাসিন্দারা সবাই দৈনন্দিন কাজে বাইরে ছিলেন। খবর পেয়ে তারা ছুটে এসে শেষ সম্বলটুকু বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা চালান। তবে আগুনের ভয়াবহতায় রক্ষা করতে পারেননি বাড়িঘর।
বস্তিতে আগুনে ৬৫ বছরের দিনমজুর আব্দুল জলিলের এক লাখ টাকা পুড়ে ছাই হয়েছে। সন্তানরা দেখাশোনা না করায় পাঁচ বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে জলিল দুটি ঘর নিয়ে এই বস্তিতে একাই থাকতেন। দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নিজের আপদ-বিপদের জন্য তিন বছর ধরে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। আজ সকালে টাকাগুলো চালের বাক্সের নিচে রেখে কাজের সন্ধানে বাইরে যান। আগুন লাগার খবর পেয়ে এসে দেখেন পুরো ঘর পুড়ে ছাই। অনেক কষ্টে সঞ্চয়ের টাকা খুঁজে পেলেও টাকাগুলো আগুনে পোড়া দেখে আর্তনাদ করতে থাকেন আব্দুল জলির। তিনি বলেন, ‘আমার সব শেষ। বাড়িঘর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলো।’
একটি বেসরকারি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন ৪৫ বছর বয়সী ফজিলা বেগম। সকাল ৯টায় টিনের দুই ঘরে তালা দিয়ে তিনি কর্মস্থলে গিয়েছিলেন। আগুন লাগার খবর পেয়ে বস্তিতে এসে দেখেন একযুগের সাজানো ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিলাপ করতে করতে ফজিলা বেগম বলেন, ‘ভাই সবতো শেষ। ঘরে আসবাবপত্র, জমানো টাকা সব পুড়ে গেছে। অন্তত তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চেলোপাড়ার শিমুলতলী বস্তিতে ১৭০টি পরিবারের বসবাস। সবগুলো ঘর এখানে টিন দিয়ে বানানো। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সর্বস্ব হারিয়ে আহাজারি করা মানুষগুলো ছোটাছুটি করছেন। ছাইয়ের মধ্যে খুঁজছেন ঘরে থাকা মূল্যবান সম্পদ। তবে অনেকে নিজের ঘর যেন চিনতে পারছিলেন না। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে তাদের শোবার খাট, টিভি, ফ্রিজসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। হাঁড়ি-পাতিলসহ রান্না করার সামগ্রী পুড়ে যাওয়ায় অনেকের ঘরে চুলা জ্বালানোর মতো অবস্থাও নেই। তাদেরই একজন রঞ্জু মিয়া। তিনি বলেন, ‘বস্তিতে আমার তিন ঘর নিয়ে বাড়ি। কিছু টিন ছাড়া সব পুড়ে গেছে। এখন আমি একবারে নিঃস্ব।’
অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না বস্তিবাসী। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বগুড়ার উপ-সহকারী পরিচালক খন্দকার আব্দুল জলিল বলেন, খবর পেয়ে দ্রুততম সময়ে চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। তবে তদন্ত শেষে নিশ্চিত হওয়া যাবে। ক্ষয়ক্ষতি বলতে ১৪ টি পরিবারের সবগুলো ঘরই পুড়ে গেছে, টাকার অংক এখন নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।
বগুড়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র দাস বলেন, আগুনের খবর পেয়ে এখানে এসেছিলাম। দ্রুততম সময়ে নিয়ন্ত্রণে না এলে পুরো বস্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ১৪টি পরিবারই একদম নিম্নবিত্ত ও দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এরইমধ্যে তাদের এক সপ্তাহের বাজার করে দিয়েছি। প্রশাসন থেকে আজই সবরকম সহযোগিতা করা হবে।
এদিকে শহরের চেলোপাড়া বস্তিতে আগুন লাগার এক ঘণ্টা পর শাজাহানপুর উপজেলার ডোমনপুকুর গুচ্ছগ্রামে আগুন লাগে। এ ঘটনায় গ্রামটির ১০টি পরিবারের ঘর পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। খবর পেয়ে উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট প্রায় ৪৫ মিনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ডোমনপুকুর গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা জানান, গ্রামটিতে ৫০টি পরিবার বসবাস করে। বিগত জোট সরকারের সময় সবগুলো ঘর টিন দিয়ে তৈরি করা। এরমধ্যে দক্ষিণ পাশের একটি সারিতে থাকা মালেক মিয়ার বাড়ি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রথমে গ্রামের মানুষ পানি ঢেলে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। পরে আগুন পাশের ঘরগুলোতে ছড়িয়ে গেলে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়। আগুনে যাদের ঘর পুড়েছে সবাই দিনমজুর অথবা ছোটখাটো ব্যবসায়ী। ঘরে থাকা আসবাপপত্র, জমানো টাকা ও সোনার গহনা সবই পুড়ে গেছে।
চেলোপাড়া শিমুলতলী বস্তির মতোই শাজাহানপুরের ডোমনপুুকুরের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা পান ব্যবসায়ী নাজু ও গরু ব্যাপারী শাহিন আলমের একই পরিণতি হয়েছে। আগুনে নাজুর পাঁচ বছরের জমানো দুই লাখ ও শাহিনের ব্যবসার মূলধন পাঁচ লাখ টাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছিলেন নাজু। তিনি বলেন, সব পুড়ে গেছে। টাকা নয় যেন কপাল পুড়েছে আমার। শাহিন বলেন, কিশোর বয়স থেকে পরিশ্রম করে করে এই টাকা জমিয়ে ব্যবসা করতাম। এখনতো সব শেষ।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স শাজাহানপুরের স্টেশন কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তদন্ত করে আগুনের সূত্রপাতের সঠিক কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানানো হবে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রাথমিকভাবে একমাসের খাবার, নতুন বাড়ি নির্মাণের জন্য টিন ও কম্বল দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি পরিবারের নগদ টাকা পুড়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। তাদের টাকার গায়ে নম্বরের অংশ যদি ঠিক থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করলে টাকা ফেরত পাবে। বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এসআর/এমএস