সবুজ পাহাড় আর কাপ্তাই লেকের এক অপূর্ব সমন্বয় রাঙামাটি। এশিয়ার বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম এই হ্রদটি আষ্টেপৃষ্টে যেন বেঁধে রেখেছে রাঙামাটির বিশাল পাহাড়গুলোকে। তাই পাহাড় এবং হ্রদের যৌথ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে রাঙামাটি ভ্রমণের জুড়ি নেই। বিশেষত বর্ষা মৌসুমে রাঙামাটির রূপ-লাবণ্য আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। পাঁচ বন্ধু মিলে তাই বের হলাম রাঙামাটি ঘুরে দেখতে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে যাওয়া যায় রাঙামাটি, প্রায় ৮-৯ ঘণ্টা সময় লাগে।সকালে রাঙামাটি পৌঁছে উঠলাম শহরের ঠিক মাঝেই অবস্থিত ‘হিল পার্ক’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে। মোটামুটি সাধ্যের মধ্যেই ভালো মানের বেশ কয়েকটি হোটেল আছে এখানে। এসিসহ সব ধরনের উন্নত সুযোগ-সুবিধা আছে হোটেলগুলোতে। হোটেলের কাছাকাছি দূরত্বে বেশ কিছু ভালো রেস্টুরেন্ট আছে, কাপ্তাই লেকের কয়েক প্রজাতির সুস্বাদু মাছও পাওয়া যায় এতে। দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেলে ঘুরতে বের হলাম রাঙামাটি শহরের ভেতরেই।প্রথমে গেলাম রাজবন বিহারে। প্রয়াত বৌদ্ধ ভিক্ষু বনভ্রান্তের বৌদ্ধবিহার এটি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বৌদ্ধবিহারটি কাপ্তাই লেকের ধার ঘেষেই অবস্থিত। এখানে অনুষ্ঠিত কঠিন চীবর দান উৎসবে প্রতিবছর লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত অসংখ্য পুণ্যার্থী ও দর্শণার্থীর সমাগম ঘটে বিহারটিতে। বিহারটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির, বিশ্রামাগার, তাবতিংস স্বর্গ (সাতটি স্বর্গের আদলে গড়া সাততলা দালান)। প্রতিটি মন্দিরেই রয়েছে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধমূর্তি। এছাড়াও মন্দিরের একাংশে কয়েকটি বানরের দেখাও মেলে সহজেই।রাজবন বিহারের ঠিক পাশেই চারপাশে কাপ্তাই লেক ঘেরা চাকমা রাজার বাড়ি। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী রাজার বাড়ির চারপাশে বিশেষ সুরক্ষা স্বরূপ পরিখা নির্মাণ করা হয়, যাতে শত্রুর সহসা আক্রমণ ঠেকাতে কিছুটা প্রস্তুতি নেয়া যায়। সেই রীতিটি এখনো ধরে রাখা হয়েছে এখানে। ছোট্র ট্রলার দিয়ে যেতে হয় চাকমা রাজার বাড়িতে। বাড়ির ভেতরের সম্মুখ ভাগেই চাকমা রাজাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। রাজবাড়ির পাশেই রয়েছে মোঘল আমলে চাকমা রাজা কর্তৃক উদ্ধারকৃত ফতে খাঁর সুসজ্জিত কামান। পুরো পরিবেশটাতে কিছুটা যেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ছাপ চোখে পড়ে।রাজবাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। পরদিন সকালে ইঞ্জিনচালিত বোট ভাড়া করে চললাম কাপ্তাই লেক ধরে। ভয় নেই, যারা সাঁতার জানেন না তাদের জন্য এখানকার বোটে লাইফ জ্যাকেটও রয়েছে। সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলা বিশাল লেকের স্বচ্ছ পানি আর বিস্তীর্ণ আকাশের ভাসমান মেঘের ভেলা আপনাকে অন্য এক পৃথিবীতে নিয়ে যেতে বাধ্য। রাঙামাটির বরকল উপজেলা পেরিয়ে আড়াই ঘণ্টা পর পৌঁছলাম সুবলং ঝর্ণায়। বিশাল পাহাড়ের উপর থেকে পড়ছে ঝর্ণার পানি। দুপুরের গরমে যেটুকু ক্লান্ত লাগছিল, তার পুরোটাই দূর হয়ে গেল ঝর্ণার শীতল পানিতে গোসল করে।দুপুরে খেতে গেলাম সুবলং ঝর্ণা থেকে এক ঘণ্টার পথ ‘চাং পাই’ রেস্তোরাঁয়। কাপ্তাই লেকের পাশেই পাহাড়ের উপর মনোরম এই রেস্টুরেন্টে মিললো এক চাকমা খাবারের পদ, ‘চুঙ্গাত ক্রুহেরা’। মূলত বাঁশের কঞ্চির ভেতর বিশেষ কায়দায় রান্না করা মুরগির মাংস এটি, যা কিনা কলাপাতার উপরে বাঁশের চোঙ্গাতেই পরিবেশন করা হয়। লেকের ধারে মাচায় বসে পড়ন্ত দুপুরে এই ভিন্ন স্বাদের খাবার খাওয়ার অনুভূতিটি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এখানে সব কিছুই প্রকৃতির নিজস্ব আদলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে, যাতে আদিবাসীদের জীবন ধারণের ছোঁয়াও বেশ স্পষ্ট।বিকেলে সবশেষ গেলাম পর্যটন মোটেলের ধারে অবস্থিত ঝুলন্ত সেতু দেখতে। সেতুটি বর্ষায় পুরোপুরি ডুবে গেলেও বাকি সময় এর ওপর দিয়ে ঠিকঠাক যাতায়াত করা যায়। অনেক লোক এর উপর দিয়ে একসঙ্গে চলতে থাকলে সেতুটি মৃদু দুলতে থাকে। ঝুলন্ত সেতুর বিপরীত প্রান্ত ধরে এগোলে ঘণ্টা হিসেবে কাপ্তাই লেক ঘোরার জন্য ‘সাম্পান’ পাওয়া যায়। সাম্পান বিশেষ ধরনের এক কাঠের নৌকা, সাম্পানে করে কাপ্তাই লেকে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাও অসাধারণ। মনে হবে যেন স্বপ্নপুরীর ভেলায় ভেসে আপনি চলেছেন দূর থেকে বহু দূরে, যেখানে সবুজ পাহাড় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।সন্ধ্যায় কাপ্তাই লেকে বোটের ছইওলা ছাদে বসেই রক্তিম সূর্যটাকে ডুবে যেতে দেখলাম। ঘরে ফিরতে ফিরতে মায়াবী জোছনার রূপালি আলো লেকের পানিতে পড়ে তাকে আরো মোহাচ্ছন্ন করে তুলেছে। পাহাড়ও যেন সেই জোছনা গায়ে মেখে এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি করলো। রাতে রাঙামাটি শহরেই বেশ কিছু কাপড়ের দোকান ঘুরে দেখলাম। এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর হাতে তৈরি অনেক ধরনের তাঁতের জিনিস যেমন, বিছানা চাঁদর, ফতুয়া, শাড়ি, ওয়ালেট ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়।সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি রাঙামাটি। এখানে সুউচ্চ পাহাড়গুলোকে যেন পরম মমতায় ধরে রেখেছে কাপ্তাই লেক। লেকের পানিতে বিস্তীর্ণ আকাশ আর মেঘেদের প্রতিচ্ছবি পর্যটকদের মন কাড়ে অনায়াসেই। সব মিলিয়ে যেন সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা এক শান্ত জলের ছুটে চলার জাদুতে রহস্যময় রাঙামাটির সমগ্র সৌন্দর্য!বিএ