ধর্ম

মুসলিম সমাজে মসজিদের ভূমিকা

মূল: মওলানা ইলিয়াস নোমানি

Advertisement

অনুবাদ: মওলবি আশরাফ

মুসলমানদের জন্য মসজিদ কেবল ইবাদতের জায়গা নয়। লোকজন কয়েক রাকাত নামাজের জন্য যাবে, নামাজ শেষে আবার ফিরে আসবে—মসজিদের উদ্দেশ্য এমন নয়। আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শিক্ষা ও কর্মপদ্ধতি থেকে বোঝা যায় তার দৃষ্টিতে মসজিদ ছিল মুসলমানদের সবধরনের সামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্র। মসজিদকে তিনি মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষার এমন একটি কমিউনিটি হল (Community Hall) হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন—যেখানে মানুষ ইসলামের সব রকম বুনিয়াদি শিক্ষা পাবে, আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক উন্নয়নের দীক্ষা পাবে।

আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সময়ে মসজিদ যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল, আবার ছিল তরবিয়ত ও আত্মশুদ্ধির কেন্দ্র। সেখানে রীতিমতো ক্লাস হতো, আল্লাহর মহত্ত্ব নিয়ে আলোচনার মজলিস হতো, ধারাবাহিক ওয়াজ-নসিহত করা হতো। জুমার দিন খুতবা প্রদান করা হতো—পুরো মদিনা নগরী ও তার আশপাশের বাসিন্দারা সেদিন একত্র হতো, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের উদ্দেশ্যে হেদায়েতের বাণী পেশ করতেন। এ ছাড়াও প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজের জায়গায় বসে জনসাধারণকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতেন।

Advertisement

হজরত সিমাক ইবনে হারব (রহ.) বর্ণনা করেন, আমি জাবির ইবনু সামুরাকে (রা.) জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে বসেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, বহুবার। তারপর তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে স্থানে ফজরের নামাজ আদায় করতেন, সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকতেন। তারপর যখন সূর্য উদিত হতো, তখন তিনি নামাজে দাঁড়াতেন। আর লোকেরা সেখানে ‘জাহিলি যুগের মতো’ কথাবার্তা বলত ও হাসাহাসি করত, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (সেসব দেখে) মুচকি হাসতেন। (সহিহ মুসলিম: ৬৭০)

বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়—অনেক সময় অন্যান্য নামাজের পরও আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের উদ্দেশ্যে নসিহত পেশ করতেন, কখনো কখনো নামাজের সময় ছাড়াও মসজিদে সবাইকে একত্র করে দীনের হুকুম-আহকাম বিষয়ে তালিম দিতেন।

আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অবর্তমানেও সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে দীনি বিষয়ে আলোচনা করতেন। কেউ কেউ শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করে অন্যদের শেখাতেন। এমনই এক মুহূর্তের কথা হাদিসে উল্লেখ আছে, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে গিয়ে দেখলেন দুটি মজলিস চলছে। একটি মজলিসে ইসলামের প্রয়োজনীয় বিধিবিধান শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে আল্লাহর মহত্ত্ব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তিনি দুদিকেই ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকালেন, কিন্তু শিক্ষার মজলিসকে বেশি ভালো বললেন। (সুনানে ইবনে মাজা: ২২৯)

কিছু কিছু হাদিসে ওই মজলিসগুলোতে শিক্ষার পদ্ধতি ও নিয়মের পূর্ণ বিবরণ এসেছে। যেমন, হজরত জুনদুব বিন আবদুল্লাহর (রা.) এক বর্ণনা থেকে জানা যায়—সবার আগে ঈমান শিক্ষা দেওয়া হতো, তারপর দেওয়া হতো কোরআন বোঝার শিক্ষা। (সুনানে ইবনে মাজা: ৬১)

Advertisement

অন্য এক বর্ণনায় জানা যায় কোরআন শিক্ষার পদ্ধতি কেমন ছিল— প্রথমে দশ আয়াত পড়ানো হতো বা মুখস্ত করানো হতো, তারপর সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শেখানো হতো। এরপর পরবর্তী দশ আয়াত পড়া হতো। (মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে আনসার, ২২৩৮৪)

এসব মজলিসে উপস্থিত হতে উৎসাহ দিতে গিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) একবার বলেন, ‘আমার এই মসজিদে যে ব্যক্তি উত্তম শিক্ষা শিখতে ও শেখানোর নিয়তে আসে, তার উদাহরণ আল্লাহর পথের মুজাহিদের মতো।’ (সুনানে ইবনে মাজা: ৮/২২৭)

এ ছাড়া যেসব শিক্ষার্থীর মদিনায় থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল না, মসজিদের একপাশে ‘সুফফা’ (পাতার ছাউনি দিয়ে ঘেরা ঘর) বানিয়ে তাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল।

নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুগে শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপার ছাড়াও মসজিদে আরও নানা ধরনের কাজ হতো। মসজিদে নববি থেকেই মদিনা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। সেখানেই আদালত বসত। সেখানেই সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধান ও গরিব-অসহায়দের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করা হতো। তবে বিভিন্ন হাদিস ও সিরাত থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়—শিক্ষা-দীক্ষা ও ওয়াজ-নসিহতের মজলিসই আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে বেশি হতো।

ওএফএফ/জেআইএম