অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ভাষণে তিনি রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন। প্রত্যেকটি খাতে কী ধরনের সংস্কার আনা হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। ভাষণে তিনি কৃষি, স্বাস্থ্য ও আর্থিকখাতের দুর্নীতি ও বেহাল অবস্থার চিত্র তুলে ধরে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে কৃষিখাত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে কৃষকের স্বার্থ যেন সুরক্ষিত থাকে, কৃষক যেন তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান, তা নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, প্রবাসী শ্রমিকরা যেভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছেন, মুক্তিকামী জনগণ তা কৃতজ্ঞচিত্রে স্মরণ করে। তাদের প্রতিও সব পর্যায়ে সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করা হবে।
স্বাস্থ্যখাতে জবাবদিহিতা ফেরানো হবেড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। জনগণের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। এ খাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সেখানে সরকারি চিকিৎসকসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা যাতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত না থাকে, দেশের সব অঞ্চলের মানুষ সমান স্বাস্থ্য সেবা পান, সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশনব্যাংকিং খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এ খাতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার আমরা উদ্যোগ সচল করেছি।
আরও পড়ুন: বিদেশি সাংবাদিকদের দ্রুত ভিসা দিতে নির্দেশ দিয়েছি: ড. ইউনূসগ্রেফতারদের ওপর হামলার প্রবণতা থেকে বের হতে হবে: প্রধান উপদেষ্টাদেশ ঘুসের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত, মুক্তির পরামর্শ দিন: ড. ইউনূসপ্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, আর্থিকখাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করা হবে, যা দ্রুত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। শেয়ারবাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বিচার বিভাগ দলীয় প্রভাবমুক্ত হবেবিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়না ঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সব অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহীতামূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। বাংলাদেশকে আর কোনো দিন কেউ যেন কোন পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত না করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উন্নয়ন হবে টেকসই ও পরিবেশবান্ধবড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের বিষয়ে তারা ওয়াকিবহালই শুধু নয়, তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে, তা টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব। প্রকৃতি ধ্বংসকারী উন্নয়ন নয়। শুধু জিডিপি একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না।
তিনি বলেন, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বন, মাটি আর বাতাস ধ্বংস আর দূষিত করে যে উন্নয়ন হয়, তা দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নয়। জীবাশ্ম জ্বালানি বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের সাথে আমাদের সরকারের অবস্থান সামঞ্জস্যপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ একটি পৃথিবী রেখে যেতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার বিকল্প নেই। আমাদের সরকার পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। এ কার্যক্রমে তরুণ সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা হবে।
এএএইচ/এসএনআর/জেআইএম