করোনার সঙ্গে ৫ যোদ্ধার লড়াইয়ের গল্প
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সার হাট উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক অনামিকা বিশ্বাস (২৭)। হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন তিনি। জেলায় করোনা আক্রান্ত প্রথম চিকিৎসক তিনি। তার স্বামী রাজু বিশ্বাস আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। স্ত্রী আক্রান্তের তিনদিন পর রাজু বিশ্বাসেরও করোনা শনাক্ত হয়। করোনা শনাক্তের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই দম্পতি। তবে মনোবল হারাননি। নিজে আক্রান্ত তারপরও স্ত্রীকে সাহস জুগিয়েছেন রাজু বিশ্বাস। চালিয়ে গেছেন করোনার বিরুদ্ধে চিকিৎসা, জিতেও গেছেন। সুস্থ হয়ে আবারও ফিরেছেন কর্মস্থলে। তবে স্ত্রীকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা কাটেনি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটছে চিকিৎসক রাজু বিশ্বাসের।
অনেকটা একই রকম মানসিক অবস্থা বরিশালের উজিরপুর উপজেলার আরেক চিকিৎসক দম্পতির। চিকিৎসক শওকত আলী উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। তার স্ত্রী নাদিরা পারভিন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের চিকিৎসা কর্মকর্তা। এই চিকিৎসক দম্পতির ১৬ মাস বয়সের কন্যাসন্তান রয়েছে। তারপরও তাদের কাছে দায়িত্বই বড়। ছোট সন্তানকে বাসায় রেখে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। নিজেদের নিয়ে না যতখানি চিন্তা, তার চেয়ে দুধের শিশু নাজিফাকে নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় থাকেন। নাজিফাই তাদের সব চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা করোনায় আক্রান্ত হলে নাজিফাকে কে দেখবে। তবে শওকতের মনোবল অটুট রাখতে স্ত্রী নাদিরা তাকে আশান্বিত করছেন। আশাবাদের গল্প শোনাচ্ছেন। এই দুর্যোগে মানসিকভাবে মনোবল বাড়াতে শওকতের পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন নাদিরা।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট বিভুতিভূষণ হালদারের গল্পটা একটু অন্যরকম। বরিশাল বিভাগের একমাত্র করোনা পরীক্ষাগার শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ২৯ মার্চ থেকে শুরু হয় পরীক্ষা কার্যক্রম। নমুনা নেয়ার জন্য হাসপাতালের পাঁচ টেকনোলজিস্টের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই পাঁচজনের মধ্যে চারজন বিভিন্ন অজুহাতে তালিকা থেকে নাম বাদ দিলেও সাহস নিয়ে এই কাজে যুক্ত হন হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট বিভুতিভূষণ হালদার। তিনি একাই এখন সংগ্রহ করছেন নমুনা। ঝুঁকি জেনেও ভয়কে জয় করে নমুনা সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বরিশাল মেডিকেল এবং স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভুতিভূষণকে ‘করোনাযুদ্ধের নায়ক’ হিসেবে অবহিত করেছেন।
বিভুতিভূষণকে নিয়ে দুঃসহ এক উদ্বিগ্নের মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তার পরিবারের। তারপরও ছোটভাইকে কাজ করতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন বড় সুব্রত হালদার। শুরু থেকে এই করোনাযোদ্ধার মনোবল চাঙ্গা রেখেছেন তার বড় ভাই সুব্রত হালদার।
প্রথম সারির এই পাঁচ করোনাযোদ্ধা ও তাদের আপজনদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা হয় এ প্রতিবেদকের। কীভাবে তারা এই কঠিন সময় পার করছেন, লড়াইয়ের সেসব কথা বলেছেন প্রতিবেদকের সঙ্গে। তা তুলে ধরা হলো..
চিকিৎসক রাজু ও অনামিকা বিশ্বাস
রাজু ও অনামিকা বিশ্বাস ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পাস করে তারা দুজনই বিসিএস দেন। ৩৯তম বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে মাঝামাঝি আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। সরকারি চিকিৎসক হিসেবে এটাই তদের প্রথম কর্মস্থল। একই কলেজে পড়ার সুবাদে তাদের মধ্যে আগেই জানাশোনা ছিল। পরে পরিবারের সম্মতিতে গত ১১ মার্চ বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। নতুন এই দম্পতির সংসারে সুখের কমতি ছিল না। এই চিকিৎসক দম্পতি পার্শ্ববর্তী গৌরনদী উপজেলায় একটি বাসায় ভাড়া থেকে প্রতিদিন আগৈলঝাড়া উপজেলায় এসে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন।
সময়টা মার্চের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে, গ্রামের দিকে করোনা তখনও সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। যা পাওয়া যাচ্ছে তার বেশির ভাগই ঢাকায়। সেই সঙ্গে নতুন করে নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরেও সংখ্যা বাড়ছে। এ সময় চিকিৎসক রাজু বিশ্বাস উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও অনামিকা বিশ্বাস উপজেলার পয়সার হাট উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন। এর পরের দৃশ্যপটগুলো খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। গত ১১ এপ্রিল বিকেলে দুজনই হাসপাতালের দায়িত্ব পালন শেষে বাসায় ফেরেন। রাজু বিশ্বাস দেখেন স্ত্রী অনামিকার শরীর ভালো না। ঋতু পরিবর্তনের কারণে সর্দি-কাশি, গলাব্যথা হয়েছে- এমনটা ভেবে স্ত্রীকে প্যারাসিটামল সেবন করতে বলেন। কিন্তু উপসর্গগুলো বাড়লে ১২ এপ্রিল স্ত্রী অনামিকার নমুনা পরীক্ষা করান। পরদিন ১২ এপ্রিল আক্রান্ত হওয়ার খবর জানতে পারেন। সব আনন্দ, কোলাহল থেমে গিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে নেমে আসে ঘন অন্ধকার। ভেঙে পড়েন অনামিকা বিশ্বাস।
তারপর বেশ দ্বিধায় ছিলেন কোথায় চিকিৎসা করাবেন তা নিয়ে। যেহেতু শরীর তেমন একটা খারাপ ছিল না, তাই সিনিয়র চিকিৎসকসহ পরিচিত অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাসায় যথাযথ নিয়মে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে বাসায় থাকা নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। এলাকায় জানাজানি হলে প্রতিবেশীরা তাদের অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। মানুষ নানা কথা বলতে থাকে। তবু তারা সহ্য করে গেছেন। পরিস্থিতির কারণে কিছুই বলার ছিল না তাদের। এসব কারণে ১৪ এপ্রিল তারা দুজনই ভাড়াবাসা ছেড়ে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হন। সে সময় রাজু বিশ্বাসের শরীরেও করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। ১৬ এপ্রিল রাজু বিশ্বাসেরও করোনা শনাক্ত হয়। এরই মধ্যে স্ত্রী অনামিকার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। রাজু বিশ্বাসের ভয় বাড়তে থাকে। নিজেকে নিয়ে না যতখানি, তার চেয়ে স্ত্রী অনামিকাকে নিয়ে। তখন অনামিকার স্বাস্থ্য অবনতির দিকে। রাজু বিশ্বাসের একটাই ভয়, নিজের যা হোক অনামিকা এ ধকল সামলাতে পারবে তো। যেকোনোভাবেই হোক তাকে সুস্থ করতে হবে। রাজু বিশ্বাসের যে কষ্ট হচ্ছে, এটা যেন কোনোভাবেই অনামিকা টের না পায়। তা হলে অনামিকা আরও ভেঙে পড়বে। এরপর ঊর্ধ্বতন চিকৎসা কর্মকর্তাদের পরামর্শে গত ১৮ এপ্রিল তাদের দুজনকেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠানো হয়।
চিকিৎসক রাজু বিশ্বাস বলেন, ১৮ ও ১৯ এপ্রিল অনামিকাকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম। এই দুদিন অনামিকার শ্বাসকষ্ট, পাতলা পায়খানা, পেট ও গলাব্যথা বেড়ে যায়। পাশাপাশি আমার শরীরও বেশ খারাপ ছিল। এর মধ্যে খবর পাই করোনায় সিলেটের এক চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। আর ইতালিতে চিকিৎসকদের মৃত্যুর হার বেশি। সেই মুহূর্তে মনের যে অবস্থা হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। দুজনই ভীষণ আতঙ্কিত, ভীষণ বিষণ্ন ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। দুঃসহ ভয়ের মধ্য দিয়ে সময় কাটছিল আমাদের দুজনের।
রাজু বিশ্বাস বলেন, কাঁদতে পারতাম না, যদি অনামিকা দেখে ফেলে তা হলে, সে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়বে। মনকে শক্ত রাখতাম, কারণ করোনা এমন একটি জটিল সমস্যা, যার সে অর্থে কোনো চিকিৎসা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম সবকিছু যেন দ্রুত ঠিক হয়ে যায়।
চিকিৎসক অনামিকা বিশ্বাস বলেন, ১৮ ও ১৯ এপ্রিল তখন আমার শরীর বেশ খারাপ। রাজুর শরীরও ভালো না। তবে রাজু সংকটময় পরিস্থিতিতে সাহস জুগিয়েছে। রাজু বলতো আমরা যদি চিকিৎসক হয়ে ভেঙে পড়ি, সাধারণ রোগীরা কী করবে। তারা তো আরও ভেঙে পড়বে। তাই কান্নাকাটি করে লাভ নেই। করোনার বিরুদ্ধে ফাইট করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সুস্থ হয়ে ফিরতে হবে। আমাদের স্বজনরা অপেক্ষা করছে। তার কথা শুনে সাহস পেতাম। এ রকম আস্থা, আশ্বাস তো একজন প্রকৃত জীবনসঙ্গীই দিতে পারে। তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বেড়ে গেল। হঠাৎ করে যেন মনে হলো আমার শরীরে শক্তি ফিরে এসেছে, ভীষণ রকম ভালো লাগা নিয়ে বললাম, ভালো আছি। তুমিও তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ। আমি ভাগ্যবান রাজুর মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছি।
এভাবে চলার পর ৯ দিনের মাথায় প্রথম পরীক্ষায় তাদের করোনা নেগেটিভ আসে। পরপর দুবার নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত না হওয়ায় ২৫ এপ্রিল ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে তাদের ছাড়পত্র দেয়া হয়। ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইন শেষে গত ১০ মে দুজনই কর্মস্থলে যোগ দেন।
চিকিৎসক রাজু ও অনামিকা বিশ্বাস বলেন, প্রথমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া, স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসায় করোনাকে জয় করেছি।
তারা বলেন, আমাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। করোনার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কারও যদি করোনার উপসর্গ থাকে, তবে তিনি যাতে তা না লুকিয়ে রাখেন বা গোপন না করেন, তারা সে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এতে তার স্বজনসহ চিকিৎসকরাই সংক্রমিত হচ্ছেন, আর এই পরিস্থিতি চিকিৎসকরা আরও বেশি সংক্রমিত হওয়া শুরু করলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে, তাও অনুধাবন করার কঠিন।
চিকিৎসক শওকত আলী ও নাদিরা পারভিন
বরিশালের উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শওকত আলী ও তার স্ত্রী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের চিকিৎসা কর্মকর্তা নাদিরা পারভিন। এই চিকিৎসক দম্পতির ১৬ মাস বয়সের কন্যাসন্তান রয়েছে। তাদের কারণে ছোট শিশুটি সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এই দম্পতি করোনা পরিস্থিতির মধ্যে টানা চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, উজিরপুর উপজেলায় এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পাঁচজন। এর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন সেবিকাও রয়েছেন। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন চারজন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, অন্য হাসপাতালগুলোতে করোনারোগীদের চিকিৎসকরা ১০ দিন সেবা দেয়ার পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন। এরপর ৬ দিন পরিবারের সঙ্গে থেকে কাজে ফিরছেন। কিন্তু চিকিৎসক সংকটসহ নানা কারণে সেই সুযোগ নেই চিকিৎসক শওকত আলীর। তাছাড়া এই হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহের জন্য একজন টেকনোলজিস্ট রয়েছে। মাঝে মধ্যে তার বিশ্রামের সময় নমুনা সংগ্রহ করতে হচ্ছে শওকত আলীকে। এ পর্যন্ত ১৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি।
এদিকে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের চিকিৎসা কর্মকর্তা নাদিরা পারভিন দুধের সন্তানকে বাসায় রেখে নিয়মিত প্রসবকালীন, প্রসব-পূর্ব ও প্রসবোত্তর রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাকে জেনেশুনে রোগীদের কাছে যেতে হচ্ছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেই এই চিকিৎসক দম্পতির দিন কাটছে।
চিকিৎসক নাদিরা পারভিন বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উজিরপুর কার্যালয়ে আগের থেকে রোগী আসা কমেছে। এরপর দৈনিক ১০ থেকে ১৫ জন রোগী আসছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রসবকালীন, প্রসব-পূর্ব ও প্রসবোত্তর নানা সমস্যা নিয়ে আসছেন। তবে আমার থেকে শওকতের ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাই তাকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তাও বেশি। কারণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী আসছেন। এরমধ্যে বিভিন্ন উপসর্গের রোগী থাকছে। কার করোনা আছে, কার নেই, এটা কারও জানা নেই। তাই তার কাজটাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ভয় কিছুটা থাকলেও চিকিৎসকদের সেবা দেয়াই ধর্ম। চাইলেও আমরা সবার কাছ থেকে দূরত্ব মেনে সরে যেতে পারি না।
নাদিরা পারভিন বলেন, শওকতকে বলেছিলাম কদিনের ছুটি নিয়ে বিশ্রাম নিতে। তবে শওকত ছুটি নিল না। শওকত বলেছিল ডাক্তার হয়েছি বলেই না এই বিশেষ সময়ে করোনারোগীদের সেবা করতে পারছি। করোনারোগীর বিস্তার ঘটছে। এ সময় ডাক্তাররা চিকিৎসা না করলে কারা করবে, বলো তো। নিজে একজন চিকিৎসক। তাই শওকতের এই প্রশ্নে উত্তর দিতে পারিনি। একটা সময় নিজেদের নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দিলাম। তবে চিন্তা হয় শিশুসন্তানকে নিয়ে। আমরা যদি আক্রান্ত হই নাজিফাকে দেখবে কে? বুকের দুধ ছাড়া তো কিছুই খায় না নাজিফা। তার কী হবে? অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে শওকতের জন্য প্রার্থনা করি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দোয়া পড়ে শওকতের মাথায় ফু দেই, আল্লাহকে বলি, তাকে যেন হেফাজত করেন। সব যেন খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়।
নাদিরা পারভিন বলেন, ৭/৮ দিন আগে শওকতের হালকা কাশি দেখা দেয়। শওকতের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়। দুইদিন পর রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তখন দুইরাত নির্ঘুম কেটেছে। ভীষণ আতঙ্কে কেটেছে ওই দুইদিন। তবে আতঙ্ক শওকতকে বুঝতে দেইনি।
চিকিৎসক শওকত আলী বলেন, নাদিরা আমাকে নিয়ে সারাদিন ভয়ে থাকেন। প্রথম দিকে কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু এখন সেই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। মনোবল অটুট রাখতে নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছে নাদিরা। তারপরও সবসময় করোনা নিয়ে সচেতন থাকতে হচ্ছে, হাসপাতালের সবাইকে সচেতন করতে হচ্ছে। বাইরে থাকলে প্রতিটা মুহূর্ত খুব দুশ্চিন্তা হয়। মনে হয় এই বুঝি আক্রান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু যখন দেখি একজন করোনারোগী আমার হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন তখন খুব আনন্দ হয়। সেই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।
চিকিৎসক শওকত ও নাদিরা বলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আর্তমানবতার সেবায় যেন নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারি, সেটাই অমাদের প্রত্যাশা। সবাই দেয়া করবেন ।
টেকনোলজিস্ট বিভুতিভূষণ হালদার
ঝুঁকি জেনেও ভয়কে জয় করে নমুনা সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট বিভুতিভূষণ হালদার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন বলে ২৯ মার্চের পর আর বাড়িতে যাচ্ছেন না তিনি। পরিবারের কাছ থেকে আলাদা আছেন তিনি। বিভুতি থাকছেন নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে। বরিশাল মেডিকেল এবং স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভুতিভূষণকে ‘করোনাযুদ্ধের নায়ক’ হিসেবে অবহিত করেছেন। সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে পুরস্কৃত করেছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান ও জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বিভুতিভূষণ হালদার নয় বছর আগে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেকনোলজিস্ট পদে যোগ দেন। তিনি সদর উপজেলার চরকাউয়া গ্রামের বাসিন্দা সুধাংশু হালদারের ছেলে। এ পর্যন্ত ৪৮২ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। এর মধ্যে ৪০ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ।
বিভুতিভূষণ বলেন, নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তি, করোনার উপসর্গ বা সন্দেহ করা হয় এমন রোগীর খুব কাছে যেতে হয়। সে কারণে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রথমে হাসপাতাল থেকে পাঁচজনকে রোস্টার করে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। নমুনা সংগ্রহের কথা শুনে সহকর্মীদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। অনেকে অজুহাত দেখিয়ে দায়িত্ব এড়ালেন। অনেকে তদবির করে রোস্টার থেকে নাম কাটিয়ে নিলেন। বুঝলাম, শেষ পর্যন্ত কাজটা আমাকে একাই করতে হবে।
বিভুতিভূষণের বড় ভাই সুব্রত হালদার উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। তিনি বলেন, তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট বিভুতি। বাবা-মা তাকে আদরও বেশি করেন। ছোটবেলা থেকে বড্ড একরোখা বিভুতি। যা মন চাইবে তার, তা-ই করবে।
সুব্রত হালদার বলেন, ২৯ মার্চ দুপুর ২টার দিকে মেডিকেলের এক স্টাফ আমাকে ফোন দিয়ে জানান, আপনার ছোট ভাই বিভুতি করোনা রোগীদের নমুনা নিচ্ছে। এই কাজ অনেক ঝুঁকির। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে পাঁচজন দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন। যেকোনো সময় বিভুতি করোনায় আক্রন্ত হতে পারে। তাকে ওই কাজ করতে নিষেধ করেন। এ কথা শোনার পর আমি এক রকম বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। এক সময় আমার কণ্ঠস্বর না পেয়ে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলে লাইনটি কেটে দেয়। সংবিৎ ফিরে পেলে বিভুতিকে ফোন দেই। বিভুতি বলে এই কঠিন সময়ে একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে দূরে সরে থাকা সম্ভব নয়। তার মতে, করোনারোগী যত তাড়াতাড়ি শনাক্ত হয়ে চিকিৎসা নেবেন, ততই মঙ্গল।
সুব্রত হালদার বলেন, আগেই জানা ছিল বিভুতি সিদ্ধান্ত পাল্টাবে না। পরে তার নমুনা সংগ্রহের কাজের বিষয়টি বাবা-মাকে জানাই। বাবা-মা একেবারেই বেঁকে বসলেন। আদরের ছেলেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে রাজি হলেন না। বাবা-মাকে বোঝাতে থাকি। তোমরা চিন্তা করো না, বিভুতির কিচ্ছু হবে না। ও অনেক শক্ত ছেলে।
সুব্রত হালদার আরও বলেন, ২৯ মার্চের পর থেকে বিভুতিকে পরিবারের কাছ থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। বর্তমানে লঞ্চঘাট সংলগ্ন একটি আবাসিক হোটেলে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কবে বাড়িতে যেতে পারবে, তারও ঠিক নেই। বাবা মাঝে মধ্যে কান্না করে বলেন- বিভুতির দিকে খেয়াল রাখিস। বাবার বয়স হয়েছে, নানা জটিল রোগে ভুগছেন। এরমধ্যে বিভুতিকে নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন। তবে মা সবসময় বলেন, ওর জন্য প্রতিদিন আমি প্রার্থনা করি। ওর কিছু হবে না। খাবার ও ঘুম ভালো হলে কাজ করে যেতে পারবে।
বিভুতিভূষণ বলেন, দাদা (সুব্রত হালদার) অনেক করছেন। বাবা-মা গ্রামে থাকেন। কাজের সুবাদে দাদাকে নগরীতে থাকতে হয়। প্রথম দিকে মেডিকেল থেকে থাকার ব্যবস্থা করা হলেও খাবার দেয়া হতো না। তখন দাদা বৌদিকে দিয়ে পুষ্টিকর খাবার রান্না করিয়ে তিন বেলা পৌঁছে দিয়ে গেছেন। সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে দাদা নিজের টাকা দিয়ে উন্নতমানের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই, হ্যান্ড স্যানেটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস) কিনে দিয়েছেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন সি ভিটামিনযুক্ত ফলমূল খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মনোবল বৃদ্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্য অটুট রাখার জন্য দাদা সবকিছুই করছেন।
সাইফ আমীন/বিএ/জেআইএম